ক্রীড়া ডেস্কঃ
তীব্র গরম ও আর্দ্রতায় চার দিনের মধ্যে তিনটি ম্যাচ। মাঠেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কয়েকজন। আফগানিস্তান ম্যাচের পর তাই বাংলাদেশ দল চেয়েছে দুটি দিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে। ম্যাচের আগের দিনও ছিল কেবল ঐচ্ছিক অনুশীলন। মাশরাফি বিন মুর্তজা ছিলেন হোটেলেই। হালকা জিম করে আর বিশ্রাম নিয়ে কাটিয়েছেন সময়। বাংলাদেশ অধিনায়কের মতে, শারীরিক সামর্থ্যের এতটা কঠিন পরীক্ষায় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আগে কখনই পড়তে হয়নি।
মঙ্গলবার দুপুরের খাবারের জন্য যখন হোটেল থেকে বের হলেন মাশরাফি, তখনও হাঁটছিলেন একটু খুঁড়িয়ে। পায়ে বেশ ব্যথা। এ রকম ব্যথা বা কিছু না কিছু সমস্যা আছে প্রায় সবারই। অধিনায়কের মতে, এখানকার কন্ডিশন শরীর থেকে এতটা শুষে নেয় মনের জোর দিয়েও কাজ চলে না। তবে সেটাকে অজহুাত হিসেবে দাঁড় করাতে চান না অধিনায়ক। পেশাদার হিসেবে মাঠে জয় করতে চান এই চ্যালেঞ্জও।
গত ম্যাচে তো গরমে দলের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে সবাই কতটা ফিট হয়ে নামতে পারবেন?
মাশরাফি: এই কন্ডিশনে টানা খেলা কঠিন। কিন্তু ম্যাচ হেরে গেলে এরপর সে সব বলে লাভ নেই। এবার দুটি ম্যাচ হেরেছি। হারের ধরন নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু আবহাওয়া কতটা কঠিন, লোকে এসব বুঝবে না। বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই। মূল কথা হলো, খেলতে হবে, জিততে হবে। আমাদের কাছে লোকে সে রকম প্রত্যাশা করে। কাজেই জেতার জন্য খেলতে হবে। কিভাবে সেটা করা যায়, মাঠে চেষ্টা করতে হবে।
এই দুই দিনে কি শরীর পুরোটা তরতাজা করা সম্ভব?
মাশরাফি: পুরোটা নয়, কিছুটা করা সম্ভব। তবে মাঠে নামার পর খুব দ্রুতই শরীর কাহিল হয়ে পড়ে। এখন এসব বলে তো লাভ নেই। এসব নিয়েই খেলতে হবে।
দুই দলের সবশেষ সিরিজে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল।
মাশরাফি: ওই পাকিস্তানের চেয়ে এখনকার দল ভালো। তখন হাসান আলি, শাদাবরা ছিল না। বোলিং আক্রমণ ভালো। ব্যাটিংও ভালো। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি দিয়েই বিচার করলে তো হবে না। দল হিসেবে সম্প্রতি ওরা অনেক ভালো খেলেছে। ভালো দল ওরা। তবে ওরা ভালো মানেই যে আমরা ভালো খেলতে পারব না, তা তো নয়।
এত গরম ও আর্দ্রতায় চার দিনে তিন ম্যাচ, রিকভারির সময় মিলছে না, এতটা কঠিন অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে?
মাশরাফি: ক্যারিয়ারে কখনও এতটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইনি। আমরা দেশে যখন খেলি, ২৯-৩০ ডিগ্রিতে, ওই তাপমাত্রায় নরম্যালি ক্র্যাম্প হয় না। এর পরও মাঝেমধ্যে হয়ে যায়। কিন্তু এখানে একসঙ্গে ৩-৪ জনের ক্র্যাম্প হচ্ছে প্রায়ই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমরা এখানে খেলে অভ্যস্ত নই। চারদিনের মধ্যে তিনটি ম্যাচ খেলা ভীষণ কঠিন। আফগানিস্তানও খেলেছে, তবে ওরা এখানে অভ্যস্ত। ওরা ট্রেনিংই করে এখানে, এক সময় এখানেই ওদের হোম ছিল, অনেক ম্যাচ খেলেছে। আবু ধাবিতেই বেশি খেলেছে। ওদের জন্য একটু সহজ।
মুস্তাফিজ ৯ ওভার বোলিং করেছে। লোকে বলছে, ১০ ওভার কেন করেনি। অথচ ৯ ওভারই করার কথা না। এর পরও করেছে নিজেকে পুশ করে। এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করা উচিত।
শুধু গরমই তো না। এর মধ্যে একজন আঙুল ভেঙে দেশে ফিরে গেছে, মূল ক্রিকেটারদের আরও দুইজন ইনজুরি নিয়ে খেলছে। ওদেরকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে কাজটা কঠিন।
একটা গোছানো দলে যখন ইনজুরি সমস্যা হয়, আবার গুরুত্বপূর্ণ ২-৩ জন ইনজুরি ম্যানেজ করে খেলছে, সাকিব খেলছে, মুশফিক সারা গায়ে টেপিং করে খেলছে, তখন কিন্তু পরিস্থিতিগুলো কঠিন। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না।
আসলে এগুলো বলে লাভ নেই। লোকে বুঝবে না। আমরাও মেনে নিয়েছি। এভাবেই চলতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি আসলেই কঠিন। শরীরের ওপর কিছু করা চলে না। পারফর্ম না করতে পারলে বা কোনো সমস্যা হলে, সেটি নিয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু শরীর ভেঙে পড়লে তো শুধু মন দিয়ে চালানো কঠিন।
দলের সবাইকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন এই লড়াইয়ে?
মাশরাফি: লড়াই সবাইকে করতেই হবে। মুস্তাফিজ আগের দিন পুশ করেছে না নিজেকে? অন্য যে কোনো দিন হলে পুশ করত না। ক্র্যাম্প করার মানে, ইনজুরির সুযোগ বেড়ে যাওয়া। মুস্তাফিজ সেই ঝুঁকি নিয়েই করেছে। একটাও ইয়র্কার করেনি। চেষ্টাই করেনি। আমি যখন ওকে বলেছি যে বোলিং করতেই হবে, ও বলেছে যে, ‘ভাই, আমি অন্য কোনো কিছু চেষ্টাই করতে পারব না। নরম্যাল পেসে রান আপ নিতে পারব না। আস্তে করে গিয়ে শুধু লেংথ বল ও কাটার করতে পারব।’ ওই অবস্থায় নিজেকে ব্যাক আপ করে ও ভালো করেছে। অন্যরাও পারবে।
মুস্তাফিজ তাহলে এখন উদাহরণ?
মাশরাফি: অবশ্যই। তামিম একটা উদাহরণ সেট করে গেছে। সাকিব-মুশফিকও ইনজুরি নিয়ে খেলছে, ওরা উদাহরণ। আর সত্যি বলতে সবারই এরকম কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। আগের দিন রিয়াদ ৩০-৪০ রান করার পর থেকেই ওর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। মাঠ বড়, এক-দুই নিতে হচ্ছিল বেশি। চার-ছক্কা মারতে যাবে, দলের অবস্থা তখন খারাপ। ইনিংস গড়তে হবে সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে। এই গরমে দৌড়ে রান বেশি নিতে গিয়ে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার পরও টেনেছে প্রায় শেষ পর্যন্ত।
এভাবেই খেলতে হবে। একটা সুবিধা হতে পারে, যদি ব্যাটিংয়ে ওপরে রান আসে, শুরুতে দ্রুত রান আসে, তাহলে পরে চাপ কমে যায়। ভারতের ক্ষেত্রে যেটি হচ্ছে, প্রথম ১০ ওভারে মেরে-টেরে রান করছে। বাড়তি ঝামেলা নিতে হচ্ছে না। শুরুতে দ্রুত রান করতে পারলে পরে এত কষ্ট করতে হয় না।
টপ অর্ডারের যা অবস্থা, শুরুতে এত রান সম্ভব?
মাশরাফি: সম্ভব না বলে তো চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে।
লিটন দাস গত ম্যাচে দারুণ শুরুর পরও যেভাবে আউট হলেন, তাকে দল থেকে কতটা কি বলা হয়েছে?
মাশরাফি: তাকে বলা তো হয়েছে ভুলটা। একটা ভালো ব্যাপার ছিল যে, ও বলটা পড়তে পেরেছিল। কিন্তু শটটা ঠিকমত খেলতে পারেনি। এই সময় সিঙ্গেল নিতে পারত। আগের বলেই দারুণ বাউন্ডারি মেরেছে, টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা শট। ওই ওভার থেকে অলরেডি ৫ চলে এসেছিল। প্রতি ওভারে ঝুঁকি ছাড়া ৫ করে নিলেই ৫০ রান আসত রশিদের ১০ ওভার থেকে, আমাদের জন্য যথেষ্টরও বেশি।
তবে একটা ব্যাপার হয়েছে যে লিটন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে আশা করি। আমাদের দিক থেকে যেটা দরকার ছিল, ওকে সমর্থন করা। আস্থা রাখা। সেটা আমরা করেছি। ওপেনার আমরা খুঁজছি বলেই সময় দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। নিয়েই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, এটা কেউ বলতে পারবে না। এখন তো বাংলাদেশের ক্রিকেট এমন জায়গায় চলে গেছে, একজনকে তিনটার বেশি আরেকটি সুযোগ দিতে গেলেও ১০ বার ভাবতে হয়। এর পরও আমরা ওপেনিংয়ে সুযোগ দিচ্ছি যথেষ্ট। বিজয় (এনামুল হক) সাতটা ম্যাচ খেলেছে এ বছর। ওর জায়গায় লিটনকে নেওয়ার পর সুযোগের কথা দেওয়া হয়েছিল ওকে, টানা চারটি খেলল।
আমি আশা করি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। গত ম্যাচে সে ৪১ করেছে ৪৩ বলে, যেটা কঠিন। মুজিবকে এত ভালো খেলেছে, এত সুন্দর ইনিংসটা গুছিয়ে নিয়েছিল, এটা ওর ওপর আস্থা রাখা হয়েছিল বলেই পেরেছে। সে যখন অনুভব করেছে দল তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেটা তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করেছে। তেমনি শান্তকেও আমরা সাপোর্ট দিয়েছি। টানা ৩টি ম্যাচ খেলল।
আগের রাতে দুজন ওপেনার দলে যোগ দেওয়ার পরও আগের দুই ওপেনারকেই খেলানো নিয়ে কথা হয়েছে অনেক…
মাশরাফি: তামিমের বিকল্প তো নাই। হয় না। এখন অন্য কাউকে সেট করতে হলে তো সময় লাগবে। মুখ দিয়ে বলে ফেললেই কাজ হয়ে যাবে না। আমাদের দেশে শুধু চলে, ‘ওর জায়গায় ওরে নাও।’ সে না চললে আবার আরেকজন। কিন্তু এটা তো কাজের কথা হলো না। পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।
গত ম্যাচে বেশ কিছু ট্যাকটিক্যাল পরিবর্তন ছিল। পেসার ছিল যেমন দুই জন। ব্যাটিং অর্ডারেও ছিল কিছু ওলট-পালট।
মাশরাফি: আফগানিস্তানের বিপক্ষে শুরুতে আমাদের একজন বাঁহাতি স্পিনার দরকার ছিল বলেই রুবেলকে বসিয়ে অপুকে খেলানো হয়েছে। এটা ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত ছিল।
ইমরুলকে ছয়ে খেলানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সফল হওয়ার পর প্রশ্ন নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেটাও ছিল ট্যাকটিক্যাল। রশিদকে সে বিপিএলের নেটে খেলেছে ৩ বছর। ওকে সামলাতে পারত ইমরুল ও সাকিব। এজন্যই আমরা ব্যাটিং অর্ডার এভাবে সাজিয়েছিলাম। মিঠুন পাঁচে এক ম্যাচে পারফর্ম করার পরও তিনে এনেছি, কারণ মুজিবকে মুশফিক ও মিঠুন আটকাবে। রশিদকে সাকিব ও ইমরুল।
সাকিবও রশিদকে হাত থেকে পড়তে পারে। রান আউট না হলে ভালো খেলত বলেই বিশ্বাস করি। আর রিয়াদকে সাতে রাখা হয়েছিল ফিনিশার হিসেবে। এসব ছিল ট্যাকটিক্যাল। কঠিন সময়ে কিছু না কিছু করতে হয়। সফল না হওয়ার ঝুঁকি থাকে, কিন্তু সবকিছু করা হয় ভালো কিছুর আশাতেই।
মাহমুদউল্লাহ গত কিছু দিনে পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করছিল। সাতে নামতে আপত্তি করেননি?
মাশরাফি: ছয়ে ব্যাট করতে পারলে ওর জন্য ভালো হতো। কিন্তু আসলে ট্যাকটিক্যালি অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। ও যে সেটাকে পজিটিভিলি নিয়ে পারফর্ম করেছে, বাড়তি চিন্তা করেনি, এটা দারুণ। ওকে নিয়ে আলাদা করে বলার নেই। সব সময় ক্রাইসিসে ভালো করেছে। গত ম্যাচেও করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ২৫০ উইকেট পূর্ণ করেছেন। কিভাবে দেখেন অর্জনটাকে?
মাশরাফি: ভালো লাগছে। অবশ্যই ভালো লাগছে। তবে আমার এই অনুভূতিগুলো মরে গেছে অনেক আগেই। শারীরিক কারণে, খারাপ লাগার কারণে অনুভূতিগুলো আর কাজ করে না। এমনিতে অর্জন কিছু হলে ভালো অবশ্যই লাগে। অনেক বড় স্বপ্ন ছিল টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে। সেটি হারিয়ে যাওয়ার পর অন্য অনুভূতি আর তেমন কিছু কাজ করে না।
সূত্রঃ বিডিনিউজ