সুনীল বড়ুয়া:
সমুদ্র সৈকতের ঝাউ বাগানে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছিল। একদম মুষলধারে বৃষ্টি । কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টি কিছুই মানছেননা তারা। ভারী বর্ষন যেন তাদের আনন্দের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো। এমনই সময়ে বন্ধুদের নিয়ে গোল করে বসে গীটার বাজিয়ে গান করছিল কলেজ ছাত্র মংউথেন রাখাইন। আর সঙ্গে বন্ধুরাও সমস্বরে গাইছিল-‘গাড়ি চলেনা চলেনা’।
শুধু গান নয়, নাচ-গান, হৈ হুল্লোড়, আরো নানা আয়োজনে এক অন্যরকম আনন্দে ব্যস্ত রাখাইন তরুণ তরুণীরা। ভারী বৃষ্টির সাথে সৈকতের ঝাউবাগান জুড়ে যেন আনন্দের বন্যা বইছে। বলছিলাম, কক্সবাজারে রাখাইনদের মনরাঙানো বর্ষা উৎসবের কথা।
শুক্রবার (১৫ জুলাই) উৎসবের শেষ দিনে এমনই আনন্দ অাবাহন বয়ে গেল কক্সবাজার হোটেল শৈবাল সংলগ্ন সৈকতের ঝাউবাগানে। গত ১০ জুন শুরু হওয়া এ উৎসবের শেষ দিন ছিল গত শুক্রবার ।
জানা গেছে, প্রতি বছর বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান তিনমাসব্যাপী আষাঢী পূর্ণিমার আগে (আষাড়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত) আড়াই থেকে তিনমাস রাখাইন সম্প্রদায় সৈকতে এ উৎসব পালন করে থাকে রাখাইন সম্প্রদায়। তবে এ বছর আবহাওয়াগত কারণে উৎসবের ব্যাপ্তি একটু কমেছে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন জানান,এটি তাদের কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসব নয়, শুধুমাত্র সবাই মিলে মিশে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে মজা করার জন্যই এ উৎসব পালন করা হয়।
রাখাইন নেত্রী মাটিন টিন জানান,প্রায় শতাব্দীকাল ধরে রাখাইন সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে আসছে। এক সময় হিমছড়ির অরণ্যে এ উৎসব উদযাপন করা হতো। রাখাইন তরুণ-তরুনীরা নানা রকমের খাবার দাবারসহ চলে যেতো সেখানে। গত কয়েক বছর থেকে সমুদ্র আর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে পেতে সৈকতের ঝাউবাগানে পালন করা হচ্ছে মন রাঙ্গানো এ বর্ষা উৎসব।
রাখাইন যুবক উশিবু রাখাইন জানালেন, এ উৎসবের সাথে ধর্মীয় উৎসবের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সকল দ্বিধা-দ্বন্ধ,সংঘাত হানাহানি ভুলে সবাই মিলে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাস করে সারাদিন আনন্দে মেতে থাকার জন্যই মূলত এ আয়োজন।
রাখাইন তরুণী উমে জানালেন, এ উৎসবে এলেই অনেক পুরনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়। তাই প্রতি বছর এখানে আসার লোভ সামলাতে পারিনা। তিনি বলেন,রাখাইনেরা মজা করার জন্য এ উৎসব শুরু করলেও এখন এটি শুধু রাখাইনদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে এটি সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
উৎসবে এসে কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নে রাখাইন যুবক কেংগ্রী রাখাইনের জবাব,সবাই মিলে-মিশে বৃষ্টি এবং সাগরের জলে সিক্ত হয়ে মন রাঙানোর জন্যই মূলত এখানে আসি। বৃষ্টি বেশি,তাই আজ আনন্দও বেশি হচ্ছে।
মজার মজার হরেক রকম খাবার-দাবার নিয়ে নাচে-গানে সৈকতে চলে পিকনিকের আয়োজন। তাই অনেকে এটিকে বরষাকালীন পিকনিকও বলে। আমি বলব, এ উৎসবের মধ্যদিয়ে বরষাকে বরণ করা।
এভাবেই অনুভুতি ব্যক্ত করলেন রাখাইন তরুণী মাহ্লামে রাখাইন। তিনি বলেন,বর্ষা উৎসবের শেষ আনন্দ সমুদ্রস্নান। সারাদিন ঝাউবাগানে নেচে গেয়ে মন রাঙ্গিয়ে দিনের শেষ লগ্নে সমুদ্রস্নান শেষে বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা।
বৃষ্টির সঙ্গে নেচে গেয়ে মজা করার এ উৎসব কালক্রমে এখন পরিচিতি পেয়েছে বর্ষা উৎসব নামে। যে উৎসব এখন শুধু কক্সবাজারের রাখাইনদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। জেলার গন্ডি পেরিয়ে বান্দরবান,রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি থেকেও লোকজন এখন উৎসবে যোগ দিচ্ছেন।