একেএম আতিকুজ্জামান রাসেলের টাইমলাইন থেকেঃ
পুলকদা রামু-কক্সবাজারের এক নামে জনপ্রিয় ‘শিশুতারকা’। তাঁহার বয়স চল্লিশ অতিক্রম করিয়াছে, তথাপি তিনি ‘শিশুতারকা’ই রহিয়া গেছেন।
শৈশবে সমগ্র কক্সবাজারের মঞ্চ কাঁপানো এই তারকা সংগীতশিল্পী সংসারের হাল ধরিতে গিয়া, ছোট চারি ভাইবোনকে পড়াশুনা করাইতে গিয়া প্রথমেই বলি দিয়াছেন তাঁহার মূল্যবান সম্পদ — শিল্পীসত্তা। মঞ্চ তো বটেই, ধীরে ধীরে খালি গলায় গান গাওয়াও ছাড়িয়াই দিয়েছেন বলা যায়। আর তাই এককালে তাঁহার গান শোনা সবাই এখনো দেখামাত্রই বলেন, ‘আহা, কি গানই না গাইতে তুমি!’
১.
গান ছাড়িয়া যখন ভাইবোনদের বড় করিয়া করিয়া তাঁহারও বয়স হইতে লাগিল, তখন এই ছোট্ট সংসারে আর তাঁহার প্রাণ ভরিল না। সারা জগৎকে সংসার করিলেন। কোনদিন দেখেন নাই শোনেন নাই এমন লোকের বিপদে-আপদে ঝাঁপাইয়া পড়াতেই তখন তাঁহার যত আনন্দ।
কক্সবাজারের এক বড় সমস্যা থ্যালাসামিয়া। ইহাতে আক্রান্তদের বাঁচাইয়া রাখিতে মাসে মাসে রক্ত লাগে। পুলকদার বড় লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইল লোকজনকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। ইহাতেই তিনি ক্ষান্ত হইলেন না। উৎসাহী লোকদের উৎসাহ ধরিয়া রাখিতে তিনি নিজে গিয়া বহুদূর হইতে রক্তদাতাদের নিয়া আসিতেন, সাধ্যমত দেখভাল করিতেন, আবার নিজে গিয়া কিংবা নিজ খরচে তাঁহাদের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতেন।
ততদিনে তাঁহার বয়স বাড়িয়াছে। নামমাত্র বেতনে চাকরি করেন। প্রিয়তমা জীবনের সঙ্গী হইয়া আসিয়াছেন। মাহিনা দিয়া সংসার কিছুটা চলে, বাকিটা ভগবান চালায়। রক্তদান ও দুস্থ লোকের অন্যান্য প্রয়োজন মিটাইতে তাঁহাকে বহু ধারদেনা করিতে হইয়াছে, বউয়ের গয়না পর্যন্ত বন্ধক দিতে হইয়াছে।
২.
পুলকদার আরেক পরিচয় তিনি কৃষি বিজ্ঞানী। পাঁচ বছর হয়, তিনি আর দুই বন্ধুর সাথে মিলিয়া কৃষি খামার করিতে গেলেন। তাঁহার কথা তিনি মানুষকে বিষ খাওয়াইতে পারিবেন না। বন্ধুদের বিরোধিতার পরও তাই কীটনাশক, রাসায়নিক সারের ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোঠায় রহিল। প্রিয়জনরা সেই খামারে হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল পালনে লাভের সম্ভাবনা দেখাইল। তিনি দেখিলেন। কিন্তু সর্বজীবে দয়া যাঁহার তিনি ‘জীবনের ব্যবসা’ করেন কি করিয়া! বেশুমার বিনিয়োগের পরও সেই খামার আজ অব্দি লাভের মুখ দেখিল না।
পুলকদার দিন ফিরি ফিরি করিয়াও আর ফিরিল না।
বন্ধুবান্ধব, ভাইবোনের গঞ্জনা আগের চেয়ে বাড়িল।
৩.
মাত্র কয়েক দিন আগে কথায় কথায় তিনি বলিতেছিলেন, তাঁহার বন্ধু, প্রিয়জনরা বারবার বলে নিজেদের বাচ্চাকাচ্চার যা প্রয়োজন ততটুকু ’বিষমুক্ত’ রাখিয়া বাকি গাছপালা হইতে যাতে ব্যবসা হয় সেজন্য সেখানে অন্যদের মত সার-কীটনাশকের ব্যবহার বাড়াও। এরপর তিনি হাসিয়া হাসিয়া তাঁহার পুরানা কথাটাই আবার বলিলেন, আমার সন্তান আর পরের সন্তানে ভেদ কি!
পুলকদার এই নিগূঢ় দার্শনিক তত্ত্বকথার ঠিক দুই দিন পর গভীর রাতে তাঁহাদের ভাঙ্গা ঘর পুড়িয়া ছাই হইল। সেই ক্লিশে শব্দজোট ‘জীবন আর পরনের কাপড়’ ছাড়া সত্যি সত্যি আর কিছুই তাঁহার পরিবারের রহিল না। আমরা নিজেদের প্রবোধ দিলাম, প্রাণগুলি তো অক্ষত আছে!
অর্ধশতাব্দী আগে রামুর সম্ভবত সবচেয়ে সচ্ছল এবং বর্তমান সময়ে আমার দেখা তুলনাহীন মানবিক এই পরিবারটির দৈন্যদশা কাটিবে কাটিবে আশায় আমরা বহুদিন বুক বাঁধিয়াছি। দুর্দশা না কাটিয়া বরং দিন দিন প্রকট হইয়াছে। ইহাতে ঈশ্বরের কি নিগূঢ় দর্শন আছে তাহা তিনিই ভাল জানিবেন।
আমরা কেবল অপরের প্রয়োজনে সবার আগে তাহার পাশে দাঁড়ানো লোকটার পাশে দাঁড়াইতে পারি। পারি মাত্র জগতের সকল প্রাণের ব্যথায় ব্যথিত মানুষটার ব্যথায় একাত্ম হইতে।
পুনশ্চ:
পুলকদা তাঁহার প্রিয় কিছু ছোট ভাইয়ের অনেক জোরাজুরির পর কলসি হাতে গান ধরিয়াছিলেন। তাঁহার কৃষি খামারে বিগত আটই নবেম্বর তারিখে এই গানটি যখন তিনি গান তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। তাঁহার গাওয়া আরো গান অচিরেই প্রচার করা হইবে।