শাহ মতিন টিপু:
‘স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। আর স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হল সেটাই যেটা পুরণের প্রত্যাশা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ আবার ‘তুমি তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং তোমার অভ্যাসই নিশ্চিত ভাবে তোমার ভবিষ্যত পরিবর্তন করবে।’ এই কথা গুলো ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালামএর। বক্তৃতা করতেই ভালবাসতেন তিনি। আর বক্তৃতার মাঝেই তিনি প্রয়াত হন।
তাঁর পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম। তাঁর প্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হলো। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই প্রয়াত হন এই অসাধারণ মানব।
তিনি প্রয়াত হলেও তাঁর অনেক কথা রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। যেমন, ‘ সফলতার গল্প পড়ো না কারন তা থেকে তুমি শুধু বার্তা পাবে। ব্যার্থতার গল্প পড় তাহলে সফল হওয়ার কিছু ধারনা পাবে।’ আবার ‘জীবন এবং সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিক্ষক। জীবন শিখায় সময়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে সময় শিখায় জীবনের মূল্য দিতে।’ আবার ‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো জ্বলো’। এমন অসংখ্য সুন্দর সুন্দর কথা ছড়িয়ে গেছেন এই বিশ্ব চরাচরে ।
এ পি জে আব্দুল কালাম ছিলেন ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি। ২০০২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেও কথা বলতে ও শোনাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম, সেই বক্তৃতা অনুষ্ঠান থেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি। মেঘালয়ের শিলংয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন কালাম, সেখানেই হঠাৎ ঢলে পড়ে যান তিনি।
৮৪ বছর বয়সে এভাবেই ফুরায় তার জীবনের অধ্যায়। যাকে তার দেশের মানুষ ডাকতো ‘মিসাইলম্যান’ নামে ।
১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর কালামের জন্ম অধুনা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে। তিনি পদার্থবিদ্যা ও বিমান প্রযুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর চল্লিশ বছর তিনি প্রধানত রক্ষা অনুসন্ধান ও বিকাশ সংগঠন (ডিআরডিও) ও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় (ইসরো) বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। ভারতের অসামরিক মহাকাশ কর্মসূচি ও সামরিক সুসংহত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়।
মিসাইল ম্যান এ পি জে ছিলেন দারুণ সাদাসিধে টাইপের মানুষ। কাজের ভারে বিয়ে করার সময় মেলাতে পারেননি। দেশের জন্য অকাতরে শুধু নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। নিজেকে সাধারণের কাতারে দাঁড় করিয়ে সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। সম্ভবত এ জন্য এই নিরহংকারী মানুষটি ‘জনগণের রাষ্ট্রপতি’ হতে পেরেছিলেন। এই সাদাসিধে গোবেচারা টাইপের মানুষটি জীবনের আনন্দ খুঁজেছিলেন কাজের মাঝে। কাজই তাঁকে অমর করে রেখেছে।
কে জানত, নাদের মাঝির ছেলে ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন! কত দিন খেয়ে-না খেয়ে পড়াশোনা করেছেন। দুঃখকে তিনি জয় করেছেন তাঁর সৎ চেষ্টা দ্বারা। হারতে হারতে জিতে যাওয়া এই মানুষটি একসময় চেয়েছিলেন পাইলট হবেন। কিন্তু হয়েছিলেন পরমাণুবিজ্ঞানী। ভারতের পারমাণবিক ক্ষেত্র সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করেছে যে ব্যক্তিগুলোর হাত ধরে, তার মধ্যে এ পি জের ভূমিকা সর্বাগ্রে । এ পি জে সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের সেরা আবিষ্কার! পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন তিনি।
১৯৯৮ সালে পোখরান-দুই পরমাণু বোমা পরীক্ষায় তিনি প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছিলেন কালাম।
আগেই বলেছি, এ পি জে ছিলেন দারুণ প্রতিভাবান এক বাগ্মী। তাঁর বাকচাতুর্য মনকে ভরিয়ে দেয়, হৃদয়কে করে ইস্পাতসদৃশ, আকুঞ্জন দৃষ্টিকে করে প্রসারিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেতেন তরুণদের জাগিয়ে তুলতে, তাদের ভেতরের জীবটি লালন-পালন করার জন্য। ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় সাধারণ পোশাকের মোড়কে থাকা এই অসাধারণ মানুষটি।
২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন দুই দশকে এক কোটি ৮০ লাখ তরুণের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে তাঁর ।
এ পি জে দারুণ আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। যে রাজ্যে তিনি পদচারণা করেছেন, তা সুশোভিত করেছেন। তাই তো তাঁর অবদানকে আরো তাৎপর্যমণ্ডিত করতে তিনি তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন নিজের চিন্তাচেতনার কথা। তরুণদের মনে দারুণভাবে দাগ কেটেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের এই মহীরুহ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তরুণ-তরুণীদের মনকে আন্দোলিত করতে ছুটে যেতেন। তিনি স্বপ্ন দেখাতেন তরুণদের।
তাঁর ‘Wings of Fire’, ‘Turning Points’ কিংবা ‘Ignited Minds’ যুবসমাজের মধ্যে সহসা যে শক্তি জুগিয়েছে, তা আসলে ঈর্ষণীয়। তাঁর ‘Wings of Fire’ অন্যতম বেস্ট সেলার। ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এ বইটি। তাঁর লেখা জ্ঞানের এমন আধার, যার ভেতরে ধার ও ভার দুটিই আছে।
একাধারে তিনি একজন বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, বক্তা, লেখক সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ। জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তবে সমাজকে দূষিত করে নয়। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সেরা পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। তাঁর কর্মময় জীবনের জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।