আসাদ চৌধুরী :
শুভ নববর্ষ। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। করোনা মহামারিতে বিধিনিষেধ বা লকডাউনের কারণে পরপর দুই বছর পহেলা বৈশাখে আউটডোরে অনুষ্ঠান হয়নি। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেনি উৎসবপ্রিয় বাঙালি। এবারের পহেলা বৈশাখে তারুণ্য জেগে উঠবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবাই রুখে দাঁড়াবে- এ কথা বিশ্বাস করি। ব্রিটিশ আমলেও শিক্ষিত বাঙালি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করত। নানা ধরনের পানীয় পান আর ফুর্তি করে সেই সময় নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হতো। তরুণ সমাজ নিজ উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে নানা উৎসবের আয়োজন করত।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত হালখাতার ব্যাপক প্রচলন দেখা যেত। আমাদের শৈশব-কৈশোরে গ্রামে হালখাতা দেখেছি। এখন আর ওভাবে হালখাতা হয় বলে সংবাদ পাই না। তবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজারে এখনও হালখাতা হয়। স্বর্ণ ও শাড়ির দোকানে এখন হালখাতা সীমাবদ্ধ। অথচ এক সময় বছরের প্রথম দিন মুদি থেকে শুরু করে সব ধরনের পাইকারি-খুচরা দোকানে নতুন হিসাব খোলা হতো। সেখানে ক্রেতারা বকেয়া পরিশোধ করতেন। দোকানিরা ক্রেতাদের নানা ধরনের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।
পহেলা বৈশাখের বড় আকর্ষণ ছিল মেলা। এখনও শহরে-গ্রামে বৈশাখী মেলা হয়। এসব মেলায় করপোরেটের ছোঁয়া লেগেছে। বড় বড় কোম্পানি স্পন্সর করে, গান-বাজনা হয়। এখন বৈশাখের উৎসব অনেকটা এনজিওর স্বার্থে করা হয়ে থাকে। বললে নালিশের মতো মনে হবে। আমার শৈশবে বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের বাসুদেব বাড়ির সামনে ছোট একটি স্থানে পহেলা বৈশাখে মেলা বসত। আমাদের গ্রাম উলানিয়া থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে বসা এ মেলাকে বলা হতো গলইওয়া। ‘গলইওয়া’ শব্দটি আমি কোনো বই-পুস্তুক বা অভিধানে পাইনি। এমনকি ছাপার অক্ষরে এ শব্দটি কখনও চোখে পড়েনি। এ গলইওয়াতে আমি নিয়মিত যেতাম। আব্বা (আরিফ চৌধুরী ধনু মিয়া, তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) যেতে না বলেননি। আমার বাবা অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। তবে হিন্দুয়ানি বলে গ্রামে নানা কথা প্রচলিত থাকায় একটু নিরুৎসাহিত করতে চেষ্টা করতেন।
বাংলা বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তিতে কিছু পূজা-অর্চনা করা হয়। কিন্তু পহেলা বৈশাখ কোনোভাবেই হিন্দুদের উৎসব নয়। এটি বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এখনও এ উৎসবকে হিন্দুয়ানি বলে অপপ্রচারের চেষ্টা চলছে। এটি কেন হচ্ছে সেই ব্যাখ্যা পণ্ডিতরা দেবেন। এক সময় গানকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিল একটি চক্র। তখন মওলানা আকরম খাঁ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- কোনো কিতাবে দেখিনি গান ইসলামে হারাম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, যেখানে আল্লাহর সৃষ্টি কোকিল গান করে, সেখানে গানের ব্যাপারে এত অপব্যাখ্যা কেন? এই অপব্যাখ্যাকারীরা এক সময় বাংলা ভাষাকেও হিন্দুয়ানি বলে অপপ্রচার চালিয়েছিল। তারা বলছে, বাংলা বাম দিক থেকে লিখতে হয়, তাই এটা হিন্দুয়ানি। বাংলায় তৎসম ও সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারের কারণে এটা আরও বেশি করে বলেছিল ওরা।
সম্রাট আকবরকে বাংলা সালের প্রবর্তক বলা হয়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সাল প্রবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সম্রাট আকবরের দরবারের আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী অনেক বড় পণ্ডিত ছিলেন কিনা, জানি না। তবে তিনি গণিত শাস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তিনি হিজরি ৯৬৩ সালকে লক্ষ্য করলেন। ওই বছর থেকে বাংলা সাল প্রবর্তিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল সম্রাটের ২৯তম রাজসালে ১১ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করে। ২৮ বছর চিন্তাভাবনা করে ৯৬৩ হিজরিকে লক্ষ্য করে নতুন বাংলা বছর এলো। ১৫৮৪ কিন্তু লক্ষ্য করা হয়নি। কারণ এর শেষে খ্রিষ্টাব্দ আছে। তার মানে বুঝতেই পারছেন, ওটা অন্যদের। এ চিন্তা থেকেই হিজরি সালকে টার্গেট। আমি কী বলতে চাচ্ছি, তার আর ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না।
চিন্তা যেভাবেই করা হোক না কেন, বাংলা বছরের প্রচলন দরকার ছিল। সেটা সার্থকতাও পেয়েছে। আগেই বলেছি, পহেলা বৈশাখ এখন সমগ্র বাঙালির প্রাণের উৎসবে রূপ নিয়েছে। এপার বাংলা ওপার বাংলায় দিনটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হয়। পহেলা বৈশাখ আর একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ঘর থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বের হওয়ার উৎসব বাঙালির আর কয়টি আছে? এখানে বলে রাখি, পঞ্জিকায় ভিন্নতা থাকায় পশ্চিমবঙ্গে পহেলা বৈশাখ আমাদের পরের দিন উদযাপিত হয়। একবার আমি দেশে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পরের দিন আবার কলকাতায় গিয়ে পহেলা বৈশাখে অংশ নিয়েছি। বহু বছর আগে পহেলা বৈশাখে মন্দিরা নন্দী ও কামাল লোহানীর নৃত্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকা সংবাদ ছেপেছে।
পাকিস্তানিরা চেয়েছিল বাংলা সংস্কৃতি শেষ করে দিতে। বাংলা সংস্কৃতিকে তারা বলত হিন্দুয়ানি। আর এ কারণে বাঙালির প্রতি তাদের বিদ্বেষ ছিল। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ) সকালে এক বন্ধু ফোন করে ঘুম থেকে তুললেন। বিবিসি সরাসরি সম্প্রচার করছিল রমনার বটমূলে বোমা হামলার সেই নারকীয় দৃশ্য। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হলো। আহতদের দেখতে ঢাকায় হাসপাতালে গিয়েছি। এসব হামলা কারা করেছে, তা সবাই বোঝেন। কারা পাকিস্তানকে মদদ জোগায়, তা পানির মতো পরিস্কার। তবে এসব অপশক্তি বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। গত ৫০ বছর ধরে টেলিভিশন-বেতারে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। জীবনে শুধু একটা অনুষ্ঠানে সময়মতো পৌঁছতে পারিনি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে পহেলা বৈশাখে লাইভে আমার যোগ দেওয়ার কথা। বাংলা একাডেমি থেকে দেড় ঘণ্টা আগে রওনা দিয়েও সময়মতো কারওয়ান বাজারে পৌঁছতে পারিনি। রাস্তায় মানুষের ঢল সেদিন বুঝিয়ে দিল- অপশক্তি পরাজিত হয়েছে। তরুণরা নানা রঙের পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় নেমেছে; তরুণীদের পরনে ছিল শাড়ি; কপালে টিপ।
সাম্প্রদায়িকতাহীন একটি ভালো সময় আমরা পার করছিলাম। এ সময় হঠাৎ টিপ নিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দেখলাম। বাংলা একাডেমি শুরু থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। তখনও পাকিস্তানি মদদদাতারা সক্রিয় ছিল। বৈশাখের অনুষ্ঠানে আসা মেয়েদের শরীরে থুথু দিত একটি চক্র। আমরা সেই নালিশ পেতাম। এত বছর পর এসে একজন কলেজ শিক্ষিকার কপালে টিপ পরাকে কেন্দ্র করে পুলিশ সদস্য (যদিও সে এখন সাময়িক বরখাস্ত) যা করেছে; ঘৃণা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এ রকম অনেক পাকিস্তানি মদদদাতা এ দেশে রয়েছে। শর্ষের মধ্যে ভূত খুঁজে বের করতে হবে। এ দেশে ধার্মিকের সংখ্যা বেড়েছে- এটা সুখবর। কিন্তু আতঙ্ক হলো ধর্মান্ধতা। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে, কিন্তু টিকেনি। ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। আইয়ুব খানের আমলে টিপ পরা নিষিদ্ধ ছিল। আজকে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি পোশাকধারীদের মধ্যে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা কোথা থেকে এলো?
পান্তা-ইলিশ কখনোই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। এ সময় জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি চলছে। অর্থাৎ ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ। তাই কেউ পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাবেন না। বাংলাদেশকে বিশ্ব চেনে সাকিব-তামিমদের কারণে অর্থাৎ ক্রিকেটের জন্য। আর চেনে ইলিশের দেশ হিসেবে। আমাদের দেশের বড় বড় ইলিশ ইউরোপ-আমেরিকা যায়। মাঝে মাঝে খুশি করতে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গে আমরা ইলিশ পাঠাই। নিষিদ্ধকালে নির্বিচারে মা ইলিশ শিকারের ফলে মাছটি ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো নদীতে ইলিশ লাফাতে দেখি না। বড় ইলিশ চোখে পড়ে না। যা আছে তার দাম শুনলে মাথা ঘোরে। এ সময় ইলিশ শিকার না করে একটু বড় হতে দেন। না হলে এক সময় ইলিশের ছায়া বিক্রি হবে। কোনোভাবেই পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার সম্পর্ক নেই। যারা বাংলা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে এদিন ইলিশের আয়োজন করেন, টাকার গরম দেখান; দয়া করে আপনার থামেন। না হলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বলব- ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।’
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে পরিবর্তন এসেছে। এখন আর এদিন পঞ্জিকা কেনা হয় না। ১৯৮৭ সালের দিকে আমি গুলিস্তান থেকে ২ টাকা দিয়ে একটি পঞ্জিকা কিনেছিলাম। এ পঞ্জিকায় কোন দিন কী খাওয়া যাবে, কী করা যাবে, তা লেখা থাকত। এটা নিয়ে জার্মানিতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমার এক বিদেশি বন্ধু এটা শুনে কী যে খুশি হয়েছিল! সে কোথাও গেলে আগে আমার থেকে জেনে নিত, ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কিনা; আজকের দিনটি কেমন। মিলেও যেত। লোকনাথ পঞ্জিকায় খনার বচন লেখা থাকত। অনেক দিন সেই পঞ্জিকা কেনা হয় না। এক সময় চিঠিতে বাংলা সাল, তারিখ, মাস লিখতাম। কৃষকের কোনো সিএল (ক্যাজুয়াল লিভ), ইএল (আর্ন লিভ) নেই। এ দিনটি গ্রামের কৃষক খুব উপভোগ করত। বাড়িতে ভালো রান্না হতো। ব্যবসায়ীরা হালখাতার মাধ্যমে একটি সার্বজনীন উৎসব করতেন। এখন সময় এসেছে সব কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। না হলে বাংলা সংস্কৃতির বারোটা বাজবে।
পহেলা বৈশাখ জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ প্রবন্ধ, কবিতা ছাপছে। টেলিভিশনও বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এসো হে বৈশাখ এসো এসো- আর কতকাল শুনব! বৈশাখ নিয়ে নতুন নতুন গান লেখা, সুর ও গাওয়া দরকার। মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা বলে শেষ করি। ১৯৯৬ সালের পর কোনো এক পহেলা বৈশাখে আমি ধারাবর্ণনা করছিলাম। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল। সেদিন দেখেছি ও বুঝেছি, হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে আমাদের পহেলা বৈশাখ বিশ্বসংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করার জন্য চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা রাত ২-৩টা পর্যন্ত কাজ করে। অথচ এই মঙ্গল নামটি নিয়েও সামালোচনা। এটি নাকি হিন্দুয়ানি! তাহলে যখন কাউকে আদর করে লক্ষ্মী মেয়ে বলা হয়, সেটা নিয়েও তো আপত্তি থাকা উচিত। কারণ লক্ষ্মী তো দেবীর নাম। আসলে এসব শব্দের সঙ্গে হিন্দুয়ানির কোনো সম্পর্ক নেই।
১৯১৩ সালে ব্রিটিশ আমলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে এশীয়দের মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর পর এই ১০৯ বছর আমরা শুধু আঙুল চুষছি। আমাদের এ পেছনে পড়ে থাকার কারণ পণ্ডিতরা দেশপ্রেমের জায়গা থেকে গবেষণা করে বের করুন। নতুন বছর আরও বেশি সমৃদ্ধি এনে দেবে- এ প্রত্যাশা করছি। কেউ যেন এ দেশে না খেয়ে না থাকে; বিনা চিকিৎসায় কারও যেন মৃত্যু না হয়। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, চাকমা, খাসিয়া, মণিপুরি, রাখাইন- সবাই মিলে আমরা দেশটাতে শান্তিতে বাস করতে চাই।
আসাদ চৌধুরী: কবি
সূত্র : সমকাল