হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার
আমাদের রামু ডটকম :
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ির দুর্গম রেংরোর ম্রো পাড়ার বাসিন্দা লাপ্রে ম্রো সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর রেংরোপাড়াটিও উচ্ছেদ হয়ে যায়। শহীদ লাপ্রে ম্রো’র পরিবারের সদস্যরা তখন চলে যান আলীকদমের দুর্গম কুরুকপাতা ঝিরির পাহাড়ে। লাপ্রে ম্রো’র দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বর্তমানে এক ছেলে সিনতন ম্রো বেঁচে আছেন।
অথচ বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা লাপ্রে ম্রো’র কথা জানে না খোদ বান্দরবানের বাসিন্দারাই।
স্বাধীনতার এত বছর পরও তাঁর আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেনি সরকারি-বেসরকারি কোনো মহলই। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত এই মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র সন্তান স্বাধীনতার এত দীর্ঘ সময় পরেও অধরা রয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে শুরু করে কোন ধরণের নুন্যতম সুযোগ-সুবিধাও তাঁর পরিবার পাননি। এনিয়ে সিনতন ম্রো এর মধ্যেও অনেক কষ্ট জমাট বেঁধে আছে।
সিনতন ম্রো’র পিতার সহযোদ্ধা রামুর মোজাফ্ফর আহম্মদ এবং রমেশ বড়ুয়া লাপ্রে ম্রো এর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নাইক্ষ্যংছড়ির ঈদগড় মৌজার রেংরো ম্রো পাড়ায় ঘাঁটি গেড়ে ঈদগাঁও, ডুলাহাজারা, খুঁটাখালী, চকরিয়া ও রামুসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দেন সিনতনের বাবা লাপ্রে ম্রো। মে মাসের দিকে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ওই ঘাঁটির ওপর হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু পাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে এসে লাপ্রে ম্রো ধরা পড়ে যান এবং পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।’ সেদিন একই পথে এগোলে লাপ্রে ম্রো এর সাথে আমিও শহীদ হতাম।

এ বিষয়ে মোজাফ্ফর আহমদ আরও জানিয়েছেন, লাপ্রে ম্রো কেবল যোদ্ধা নন, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, পানি এবং আশ্রয় থেকে শুরু করে অনেক সেবা সরবরাহ করেছেন। নিজের বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। এসময় তার ছেলে যুবক সিনতন ম্রোও যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছিলেন।
এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ও তাঁর বাবার মৃত্যুর পর পাড়াটি উচ্ছেদ হয়ে যায় বলে জানান সিনতন। স্বাধীনতার পর কিছু পরিবার পাড়ায় ফিরে এসেছিল। তবে স্থানীয় একদল দুর্বৃত্ত তাঁদের জমি দখল করে নেয়। এখন পরিবার নিয়ে আলীকদমের কুরুকপাতা ঝিরির দুর্গম পাহাড়ের লেলং পাড়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছেন সিনতন। এত দিনেও কেউ তাঁদের খোঁজখবর নেয়নি।
নাইক্ষ্যংছড়ির মুক্তিযোদ্ধা মংশৈপ্ররু চৌধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এপ্রিল-মে মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রেংরোপাড়ায় অবস্থান নেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী ওই পাড়ায় হামলা চালায় ও লাপ্রে ম্রোকে হত্যা করে।
নাইক্ষ্যংছড়ি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন বলেন, লাপ্রে কেবল ম্রো জনগোষ্ঠীর নন, তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলারও একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নাইক্ষ্যংছড়ির দু-একজন মানুষ ছাড়া তাঁর সম্পর্কে কেউ জানে না।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নাইক্ষ্যংছড়ি কমান্ডার রাজা মিয়া বলেন, ‘লাপ্রে ম্রো’র পরিবার কোথায় থাকে আমরা জানি না। ২০০৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে একবার সংবর্ধনা নেওয়ার জন্য তাঁর ছেলে সিনতন ম্রো এসেছিলেন নাইক্ষ্যংছড়িতে। কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ না পেয়ে মানসিক কষ্ট পেয়ে ফিরে যান তিনি। এরপর আর কখনো যোগাযোগ করেননি।’
বান্দরবান জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবুল কাশেম বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় লাপ্রে ম্রো এর নাম আছে। তবে তাঁকে সম্মাননা জানানোর জন্য তাঁর পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।

গত বৃহস্পতিবার ২৪ মার্চ আমাদের রামু টিম সিনতন ম্রোকে সাথে নিয়ে বিষয়টি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসম শাহেদুল ইসলামকে অবগত করলে তিনি নিজেই খুব ব্যথিত হন। এসময় ইউএনও বলেন, সরকারের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শহীদ লাপ্রে ম্রো এর পরিবার এত দীর্ঘ সময় ধরে কেন কোন ধরণের সুযোগ-সুবিধা পেলেন না এই বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে তিনিও যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখালেন।
এ ব্যাপারে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, কত ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধাও কত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দিব্যি আছেন। অথচ সিনতন ম্রোদের পেটে ভাত নেই, মাথা গুজার ঠাই নেই। এ বিষয়ে সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন তিনি।