হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার
আমাদের রামু ডটকম :
সচল গর্জনিয়া সেতু দশ মাস যাবত অচল থাকায় চরম দুর্ভোগে দিন পার করছেন কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির লাখো মানুষ।
সেতু সচল না থাকায় উৎপাদিত ফসল, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, মুমূর্ষ রোগী নিয়ে নদী পারাপারে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এসব মানুষকে। সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের কোন মাধ্যম না থাকায় নদী পারাপারে দুর্দশার শেষ নেই তাদের। রোগী আনা নেয়া ও পণ্য পরিবহনে তাদের পড়তে হয় নানান বিড়ম্বনায়।
২০১৫ সালের ২৫ জুন ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত গর্জনিয়া সেতুর দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩০০ ফুট সংযোগ সড়ক বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু এখনো সেই সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় নাইক্ষ্যংছড়ি-গর্জনিয়া-বাইশারী-ঈদগড় সড়কে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ আছে। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে চারটি ইউনিয়নের লাখো মানুষ।
আসন্ন বর্ষার আগে সেতুটি চালু করা না হলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
গেল বন্যায় সেতুর সংযোগ সড়ক বিলীন হওয়ার পর ডিঙি নৌকা নিয়ে নদী পারাপার করতে গিয়ে গর্জনিয়ার ক্যাজরবিলের আশীষ নাথ, পূর্ব বোমাংখিল গ্রামের মাওলানা এখলাস, ডাকভাঙা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ওসমান গণিসহ চার ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
তাই বিষয়টি আমলে নিয়ে গর্জনিয়া সেতু দ্রুত সময়ের মধ্যে সচল করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন এতদঅঞ্চলের লাখো মানুষ।
স্থানীয়রা বলছেন, সংযোগ সড়ক নির্মাণের আগে সেতুর নিচ দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার নদী খনন করে স্রোতের গতিপথ ঠিক করতে হবে। তা না করে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করলে, বর্ষায় পানির স্রোতে সেটি আবারও বিলীন হয়ে যেতে পারে। কারণ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো জানান দিয়ে বান আসে, এসময় বাঁকখালী নদীর ভাঙন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পায়। বিলের পর বিলের ফসলের মাঠ তলিয়ে যায়, তখন গ্রামের মানুষ ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেন স্থানীয় সাইক্লুন সেন্টারে; বন্যার জল ভাসিয়ে নেয় আর বৃষ্টির ধারা ভিজিয়ে দেয় খোলা আকাশের নিচের মানবেতর জীবন যাপনকারী পরিবারগুলোকে।
৯ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা যায়, গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের সংযোগস্থলে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত গর্জনিয়া সেতুর দক্ষিণ পাশে বিলীন সড়কের জায়গায় বাঁশ ও কাঠের তৈরি সাঁকো দিয়ে লোকজন আসা-যাওয়া করছে। কৃষকেরা তরকারির বস্তা কাঁধে নিয়ে পার করছেন।
গর্জনিয়ার বোমাংখিল গ্রামের কৃষক ফরিদ আহমদ (৫০) আমাদের রামু ডটকম কে বলেন, পার্শ্ববর্তী অন্তত ২৫টি গ্রামে সবজি চাষ হয়ে থাকে। যাতায়াতের অসুবিধার জন্য সেসব সবজি রামু, কক্সবাজার ও চকরিয়ার বাজারে নেয়া সম্ভব হয় না। এতে তারা ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মুহিবুল্লাহ চৌধুরী জিল্লু বলেন, দীর্ঘ সময় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুদের ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার করতে হচ্ছে। বিলীন সংযোগ সড়ক নির্মাণে কারও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে এলজিইডি প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬১ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করে। সেতু রক্ষার জন্য ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে নদীর তলদেশ খনন করে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। পরে পলি জমে ওই অংশ পুনরায় ভরাট হয়ে যায়।
২০১৫ সালের জুন মাসে স্রোতের ধাক্কায় সেতুর এক পাশের সংযোগ সড়ক বিলীন হলে সেতুটি সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর থেকে সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী আমাদের রামু ডটকম কে বলেন, আগামী মে মাসের মধ্যে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। নইলে আসন্ন বর্ষায় ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সেতুটি ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। গর্জনিয়া সেতুর পাশে অবস্থিত সম্রাট শাহ সুজা সড়কটিও হুমকির মুখে পড়বে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম আমাদের রামু ডটকম কে জানান, ৬ এপ্রিল তিনি গর্জনিয়া সেতু পরিদর্শন করে মানুষের দুর্ভোগ দেখেছেন। বিলীন সংযোগ সড়কটি পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি কয়েক দফা এলজিইডির কার্যালয়ে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এলজিইডির কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনজুরুল আলম আমাদের রামু ডটকম কে বলেন, নদী খনন করে স্রোতধারা বা পানির গতিপথ পরিবর্তন করা না গেলে গর্জনিয়া সেতুসহ দুই তীরের ইউপি ভবন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ লোকজনের ঘরবাড়ি রক্ষা কঠিন হবে। কিন্তু নদী খনন এলজিইডির কাজ নয়। নদী রক্ষণাবেক্ষণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ ব্যাপারে পাউবোকে অনুরোধ করা হয়েছে।
পাউবোর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাবিবুর রহমান আমাদের রামু ডটকম কে বলেন, নদীর গতিপথ ঠিক রেখেই সেতুটি নির্মাণ জরুরি ছিল। এখন সেতুর নিচ দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ নদী খনন করে স্রোতের গতিপথ ঠিক করতে হবে। এ জন্য প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। বরাদ্দ এলে অল্প সময়ের মধ্যে নদীর তলদেশ খনন করে স্রোতের গতিপথ ঠিক করা হবে। এর ফলে গর্জনিয়া সেতু ঝুঁকিমুক্ত হবে। সেতুর ওপর দিয়ে আবারও যানবাহন চলাচল শুরু হলে দূর হবে মানুষের দুর্ভোগ।
জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো.আলী হোসেন আমাদের রামু ডটকম কে বলেন, গর্জনিয়া সেতুর পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি গত শুক্রবার সকালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি (সচিব) নদী খনন করে স্রোতের গতিপথ ঠিক করার জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।সাত দিনের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করে নদীতে খনন কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এদিকে গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী বলেন, শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক তাঁকে মুঠোফোনে জানিয়েছেন, গর্জনিয়া সেতু রক্ষা করা হবে। এ খবরে এলাকার মানুষ খুশি। এলাকাবাসি বিশ্বাস রাখতে চান যে জেলা প্রশাসক মহোদয় তাঁর কথা রাখবেন।