প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুঃ
নদীর ভাঙ্গন, দুষণ, ভরাট এবং দখল সম্পর্কে আমরা কম বেশি অনেকে জানি। কিন্তু বাঁকখালী কি আর এসব বুঝে! বর্ষা নামলেই বাঁকখালী তার রূপ পাল্টে নেয়। বাঁকখালী নদীর তীরবর্তী মানুষগুলো তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। তারা কিন্তু শুরু থেকে নদীর পাড়ে এসে তাদের বসতি গড়ে তোলেননি। বরং বাঁকখালী একটু একটু করে তাদের ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছে। বাঁকখালী তাদের বসত বাড়ি, ভিটা, সম্পদ, মসজিদ, মন্দির এমনকি জীবন পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। এরপরও অতীত ভুলে তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন অন্য সবার মত। কিন্তু আর কত। তারা বাঁকখালীর সাথে আর পেরে উঠছেন না। তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তারা ? তাদের এই কষ্ট এবং যন্ত্রণা কেবল চোখ দিয়ে নয় হ্নদয় দিয়ে দেখতে হবে। তাহলে বুঝা যাবে এখানকার মানুষগুলো আছেন কিভাবে।
অনেকে বলে বেড়ান রামু উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অথচ বাঁকখালীর তীরবর্তী মানুষগুলো কেবল বন্যার পানিতে বছরের পর বছর ভাসছেন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা।
গত বছরের কয়েক দফা বন্যার পানি এবং পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাঁকখালীর পাড় ভাঙ্গন তীব্রতর হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব রাজারকুলের কিছু কিছু জায়গায় অস্বাভাবিকভাবে ভেঙ্গেছে। অবস্থা এমন যে আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগে যদি ভাঙ্গন ঠেকানোর ব্যবস্থা গ্রহন করা না যায় তাহলে অনেকের থাকার আশ্রয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এটা এখন আশংকা নয়, ঘটিতব্য বাস্তবতা বলে ধরে নিতে হবে।
প্রায় ২০ বছর আগে নদীর পাড় ভাঙ্গন রোধে কিছু জায়গায় পাথরের ব্লক স্থাপন করা হয়েছিল। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে এই পাথরগুলো বন্যাসহ নানান কারণে ধসে পড়ে আছে। সবশেষে ২০১৫ সালে সংঘটিত দুই দফা বন্যার কারণে উল্লেখযোগ্য স্থানে পাথর ব্লক গুলো ধসে পড়ে এবং নতুন করে অনেক জায়গায় ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। একথাও সত্য যে যেসব স্থানে আগে থেকে পাথর ব্লক বসানো ছিল সেসব স্থান তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত ছিল।
গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তা, সেতু, কালভার্ট গুলোর মধ্যে কিছু কিছু মেরামত এবং পুনঃনির্মাণের কাজ হতে দেখা যাচ্ছে। এসব কাজের মান এবং পরিকল্পনা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে আপাতত কোন কিছু বলছি না। তবে নদী ভাঙ্গন ঠেকানোর ব্যবস্থা না করে নদীর তীরবর্তী কোন উন্নয়ন কাজ টেকসই হবে না এইটুকু বুঝার মত আক্কেল আমার হয়েছে। প্রতি বছর বছর উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা জলে ভাসিয়ে দেয়ার কোন মানে হয় না। আমাদের উন্নয়ন দরকার কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিত।
একই সাথে উন্নয়ন বৈষম্যও কাম্য নয়। সীমিত বরাদ্দ দিয়ে একসাথে সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয় কিন্তু যেটা আগে সমাধান করা জরুরী সেটাকে আগে প্রাধান্য দিতে হবে। কোনটা নির্বাচনী এলাকা, কোনটা নয়, কারা ভোট দিয়েছে, কারা দেয়নি এসব বিবেচনায় নিলে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এখানেই নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটে।
রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্বরাজারকুল একটি জনবহুল গ্রাম। এও ঠিক যে দুর্ভোগের আরেক নাম রাজারকুল। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে রাজারকুলবাসীর দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকেনা। অল্প বৃষ্টিতেই কিংবা পাহাড়ি ঢল নামলে নদীর পানি সবার ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন কারণে বাঁকখালী তার গভীরতা হারিয়েছে। সারা বছর ধরে নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করা হলেও নদী খননের কোন উদ্যোগ নেই। তার উপরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করার ফলে এবং আরো কিছু কারণে নদীর পাড় রক্ষায় স্থাপিত পাথরের ব্লক গুলো ধসে পড়ে যাচ্ছে এবং নতুন করে অনেক জায়গায় ভাঙ্গন ধরেছে। বর্তমান অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে ধসে পড়া ব্লক গুলো পুনরায় স্থাপনের পাশাপাশি নতুন করে কিছু ব্লক বসানো না হলে প্রায় ২৫০টি পরিবার চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে যাবে সন্দেহ নেই। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখলাম গত বছরের ভয়াবহ বন্যার ধাক্কা তারা এখনো সামলে উঠতে পারেননি। তারা কি রাষ্ট্রের নাগরিক নয় ? উন্নয়নের সুফল কি তাদের জন্য নিষিদ্ধ ? নিজের বাড়ি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকার অধিকার কি তাদের নেই ? না তারা কাঁদেন না বলে দুধ পান না ?
গ্রামের একমাত্র মসজিদটিও হুমকির কবলে পড়েছে। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি, মসজিদটি ২০১১ সালে তারা অনেক কষ্ট করে নির্মাণ করেছেন। কারণ পূর্বে তাদের কোন মসজিদ ছিল না। যার কারণে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে গিয়ে তাদের নামায আদায় করতে হত। এটা সবার দ্বারা সম্ভব হত না। যারা নামায আদায় করতেন যোগাযোগ সমস্যার কারণে তারাও নিয়মিত করতে পারতেন না। উক্ত মসজিদে শতাধিক পরিবার নামায আদায় এবং ধর্মীয় কাজ সম্পাদন করেন। মসজিদটা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। ফিতা দিয়ে পরিমাপ করে দেখেছি যে, মসজিদ এবং সেখানকার পরিবার গুলো রক্ষা করতে হলে দক্ষিণ দিকে অন্তত ২০০ ফুট পাথর ব্লক বসানোর প্রয়োজন আছে যার প্রস্থ প্রায় ৪৫ ফুট।
পূর্বে স্থাপিত ব্লক গুলোর প্রায় ২৫০ ফুট ধসে পড়েছে। এগুলো জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করা আবশ্যক। এছাড়াও উতর দিকে নতুন করে অন্তত ২০০ ফুট ব্লক স্থাপন করলে এদিকের বসতি গুলো সুরক্ষা পাবে। পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের অভাবে অতীতেও একটি বৌদ্ধ বিহারসহ অনেকের বাড়িঘর, জমি, ভিটে, সম্পদ এমনকি প্রাণও গেছে। তাই আর বিলম্ব কিংবা অবহেলা করা মানবিক হবে না। ধসে পড়া ব্লকগুলোর মেরামত এবং নতুন করে ব্লক স্থাপনের কাজটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে করা উচিত হবে। কারণ এখন নদীতে পানি নেই বললেই চলে। পানি কম থাকা অবস্থায় কাজ সেরে না নিলে বর্ষায় কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ হল, অন্যান্য স্থানে কিছু কিছু উন্নয়ন হলেও তাদের গ্রামে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন আজ অবধি হয়নি। চলাচলের জন্য তারা ভাল একটি রাস্তা পর্যন্ত পাননি। এর কারণ কি তারা জানেন না। নির্বাচন এলে প্রার্থীরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলে কেউ আর তাদের খবর রাখেন না।