প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু :
রামু উপজেলার অফিসের চরের পশ্চিম পাশে লামার পাড়া গ্রাম। জানা যায়, লামার পাড়া এবং অফিসের চর এলাকায় পূর্বে প্রচুর মঘ বাস করত। এমন কি সেখানে একটি বাজার ও বসত। এর নাম ছিল মঘবাজার বা থোয়াইঙ্গ্য বাজার।
প্রবাদ আছে, বাজারে যা বিক্রি হত না থোয়াইঙ্গ্য সওদাগর সন্ধ্যায় তা সব কিনে নিতেন। বর্তমানে নামটি আছে, আছে ইতিহাস। আর মহাকালের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে সেই লামার পাড়ার বিহার (ক্যাং)। তবে কোন মঘ বসতি নেই।
বিহারের গায়ে টাঙ্গানো সাইনবোর্ডে লিখা আছে বিহার প্রতিষ্ঠা কাল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। বিহারাধ্যক্ষ উ. জ্ঞানতারা থেরো বলেন, ১৯৪১ সালে এখানকার মঘরা তাদের ঘরবাড়ি, জমি, বসত ভিটা ফেলে স্বেচ্ছায় বার্মায় চলে যায় এবং সেখানে বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে। ফলে লামার পাড়াস্থ মঘ এবং তাদের নাম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পরে বিহারে একজন ভিক্ষু ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের দিকে মারা গেলে বিহারটি সুদীর্ঘ কালে ধরে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে।
১৯৯৫ সাল থেকে তিনি (বর্তমান বিহারাধ্যক্ষ) উক্ত বিহারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে বিহার এবং বিহার সীমানার অত্যন্ত নাজুক অবস্থা ছিল। তিনি আসার পর থেকে বিভিন্ন দাতাদের দান নিয়ে বিহার উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি সরকারি সহায়তায় বিহারে যোগাযোগের জন্য রাস্তা থেকে বিহার পর্যন্ত যায় প্রায় ১ কিলোমিটারের কাচা রাস্তাকে যুগোপযোগী করে তোলেন অর্থাৎ পিচ ঢালাই যুক্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। তবে এই রাস্তার অবস্থা এখন আর আগের মত নেই।
তিনি ২০০২ সালে বিহারের চারদিকের গাইড ওয়ালগুলো উপরের দিকে সম্প্রসারণ করেন। একই সালে তিনি জরাজীর্ণ বিহার সংস্কারের কাজ শুরু করেন । বিহারের সর্বমোট ১২২ টি খুঁটির মধ্যে প্রায় ৩২ টি খুঁটি পুণরায় স্থাপন করতে হয়েছে। প্রতিটি খুঁটি, মাটির নিচে ছয় ফুটসহ প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু। প্রতি খুঁটির পেছনে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। এইভাবে অনেক চড়াই উতরায় পেরিয়ে উক্ত বিহার এর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
পর্যটক বান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠায় বর্তমানে প্রতিদিন দেশি বিদেশি অনেক পর্যটকের আনাগোনা ঘটে উক্ত বিহারে। বিহারের নয়নাভিরাম কারুকার্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
ফটক দিয়ে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়ে মূল বিহারটি। উত্তর মুখী, বার্মা থেকে আনীত সিদ্ধ সেগুন কাঠ দ্বারা নির্মিত। সামনে সিঁড়ি বারান্দা। বিহারটিতে ৫০ টি খুঁটি(ঠুনি) ব্যবহার করা হয়েছে।
বিহারটি নির্মাণ করেন তৎকালীন জমিদার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থোয়াইঙ্গ্য সওদাগর। থোয়াইঙ্গ্য সওদাগর ছিলেন দানবীর দঅং দালালের শ্বশুর।
বিহারের পূর্ব পাশে রয়েছে আরো দুইটি উঁচু উঁচু মন্দির। প্রথম মন্দিরটি উঁচু পাকা ভিতের উপর সম্পূর্ণ বার্মিজ সিদ্ধ সেগুন কাঠ দ্বারা নির্মিত। মূলঘর উত্তরমুখী, সামনে রয়েছে বর্গাকৃতির বারান্দা। বারান্দা লোহার রেলিং যুক্ত। উত্তর দিকে প্রধান দরজা ছাড়াও পূর্ব পশ্চিমে আরো দুইটি দরজা রয়েছে। প্রতি পাশে তিনটি করে মোট ৯টি জানালা আছে। সামনের দিকে আছে ৪টি জানালা।
রেঙ্গুনী কারুকার্য খচিত দৃষ্টি নন্দন উক্ত মন্দিরে ৩২টি খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে। খুঁটির বেড় ৪৪ ইঞ্চি এবং উচ্চতায় প্রায় ৫০ ফুট।
বিহারটি নির্মাণ করেন থোয়াইঙ্গ্য সওদাগরের পুত্র উ ফাঁথ দালাল। তিনি প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। কলকাতা এবং রেঙ্গুনে তাঁর ব্যবসা ছিল।
বিহারের পূর্ব পাশে রয়েছে আরো একটি মন্দির। এটাও নির্মাণ করেন উ ফাঁথ দালাল। মন্দির দুইটির নির্মাণ শৈলী প্রায় একই রকম। মূলঘর উঁচু পাকা ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। সামনে রয়েছে উত্তরমূখী বর্গাকৃতির বারান্দা। অভ্যন্তরে উঁচু বেদীতে স্থাপন করা হয়েছে ১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট অষ্টধাতু নির্মিত ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অষ্টধাতু নির্মিত বুদ্ধমুর্তি।
ছয় ধাপ বিশিষ্ট ছ্উানি উপর দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠা ছাদগুলো যেকোন পর্যটককে নজর বন্ধী করে রাখার ক্ষমতা রাখে। তাই কোন পর্যটক তাড়াহুড়া করে ভেতরে ঢুকলেও সহজে বের হতে চায় না। উক্ত মন্দিরে ব্যবহার করা হয়েছে ৪০টি খুুঁটি।
বিহারের পাশাপাশি আরো একটি বিশেষ আকর্ষণ হল দুই মন্দিরের সামনে নির্মিত উত্তর পাশের ঘন্টাঘর। ঘরটি আট কোণাকৃতির। এই ঘরে দুইটি বড় বড় ঘন্টা টাঙানো আছে। ঘন্টা দুইটি গোলাকার, সুড়ঙ্গযুক্ত। কাঠের বড় মুগুর দিয়ে আঘাত করলে সৃষ্ট আওয়াজ প্রায় ৫ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। প্রতিটি ঘন্টার ওজন ৮০ মণ বলে জানা যায়।
প্রতিষ্ঠাকালে তিনটি ঘন্টা ছিল। কিন্তু সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক আগে একটি ঘন্টা চুরি হয়ে যায়। বর্তমান ও বিহারের যথাযথ উন্নয়ন এবং তদারকি হচ্ছে না। উক্ত সুপ্রাচীন পর্যটক বান্ধব ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।