হঠাৎ দরপতন ঘটেছে দেশের অন্যতম লাভজনক খাত লবণের। মৌসুমের শুরুতে কিছুটা দাম থাকলেও হঠাৎ দাম অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসায় মাঠে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে অন্তত ৫ লাখ টন লবণ। এই দরপতনের সঙ্গে ঢাকাকেন্দ্রিক শক্তিশালী আমদানিকারক চক্রের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ লবণ ব্যবসায়ীদের। এ নিয়ে লবণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ী কাজী আবুল মাসুদ জানান,‘সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে কক্সবাজারের লবণ শিল্পকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে একটি চিহ্নিত চক্র। নারায়ণগঞ্জের পরিতোষ কান্তি সাহা সিন্ডিকেট করে দেশের একমাত্র লাভজনক খাতকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বড় আরও পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।’
কক্সবাজার ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ জানান, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ থাকায় চলতি মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম ভালো ছিল। যা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করার মতো। কিন্তু দাম পড়ে গিয়ে বর্তমানে ২০০/২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ লবণ। এই দামে লবণ বিক্রি করে মজুরি খরচও উঠছে না বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্র জানায়, জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী (আংশিক) উপজেলার ১২টি কেন্দ্রে ৬০ হাজার ১৩০ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। আর লবণ চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ।
কক্সবাজার বিসিক সূত্র মতে, দেশে লবণের চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টন। এবারে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ টন। গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। ১৫ মে পর্যন্ত লবণ মৌসুম। আবহাওয়া ঠিক থাকলে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী জানান, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের উচ্চ মহলে ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করছে। দেশের লবণ শিল্প ও ক্ষুদ্র চাষিদের রক্ষা করতে হলে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের ঘোষিত লবণ নীতিমালা বাস্তবায়ন করা দরকার। সরকারের ঘোষিত দামে লবণ কিনলে প্রান্তিক চাষিরা বাঁচবে।’
সূত্র জানায়, দেশীয় লবণ শিল্পকে রক্ষার জন্য সরকার লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করলেও অনুমোদনবিহীনভাবে পরিতোষ কান্তি সাহার মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জের পূবালী সল্ট ইন্ডাষ্ট্রিজ (ইউনিট-২) তাদের চট্টগ্রাম ফ্যাক্টরির জন্য ২ হাজার ২২২টন লবণ আমদানি করে।
ভারত থেকে আনা লবণ বোঝাই মাদার ভ্যাসেলটি গত ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। মাদার ভ্যাসেলটি বহির্নোঙরে আসার পর থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লবণ খালাসের অনুমোদনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। অবশেষে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গত ১ নভেম্বর লবণের শুল্ক হিসাবে ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৮ টাকা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে লবণের চালানটি দু’টি লাইটারেজ জাহাজে সংরক্ষণের অনুমোদন নেওয়া হয়। এই অনুমোদনের ভিত্তিতে গত ২ ও ৩ নভেম্বর এমভি খলিল-১ এবং এমভি কালাম এক্সপ্রেস-১ নামের দু’টি লাইটারেজ জাহাজে ওই লবণ খালাস করা হয়। কিন্তু দেশীয় লবণ শিল্পের জন্য ক্ষতিকর দিক চিন্তা করে সংশ্লিষ্ট দফতর ওই লবণ খালাসের বিরোধিতা করে। ফলে পরিতোষ সাহার মালিকানাধীন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আমদানি রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। এখন অবৈধভাবে আমদানি করা লবণ যে কোনও উপায়ে খালাস করে দেশে বাজারজাত করার জন্য নানামুখী চেষ্টা করে যাচ্ছে এই সিন্ডিকেট।
অনুমোদনবিহীন লবণ আমদানি করা প্রসঙ্গে পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক পরিতোষ কান্তি সাহার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে আমদানির অনুমোদন দেওয়ায় আমরা লবণ আমদানি করেছিলাম। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখন আগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করলো তখন আর আমাদের এলসি বাতিল করার সুযোগ ছিল না। এ বিষয়ে মামলা চলছে। তবে, সংকট দেখিয়ে লবণ আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে আমরা লবণ কিনতে পারছি না। প্রতি কেজিতে ১২ টাকায় আমাদের কিনতে হচ্ছে। লবণ সংকট থাকায় অধিক দামে কিনতে হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
কক্সবাজার লবণশিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের (বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবসার উদ্দিন জানান, গত বছরের তুলনায় উৎপাদন হার বেড়েছে। দামও ভাল ছিল। হঠাৎ দরপতন নিয়ে কৃষকরা হতাশা প্রকাশ করছে। তিনি বলেন,আরও ১৫ দিন লবণের মৌসুম রয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন