প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুঃ
কথায় বলে, ধ্যানের চর্চা হয় গুহায়, ধর্মের চর্চা হয় মন্দিরে, নীতির চর্চা হয় পরিবারে, বিদ্যার চর্চা হয় বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ জাগতিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা লাভের স্তর ভেদে আমরা এদের বলি বিদ্যালয়, কলেজ এবং মহাকলেজ ইদ্যাদি। এসকল প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা যে জ্ঞান বা শিক্ষা লাভ করি তার নাম ফর্ম্যাল বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এটা অর্থকরী শিক্ষা ও বটে। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কোন ব্যক্তি চাকরি পায় না। ছোট বড় কোন চাকরি না পেলে তার অর্থ উপার্জন ও হয় না। তাই আপাতত দৃষ্টিতে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিকে শিক্ষিত ব্যক্তি বলে থাকি। সেই শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলতে সর্ব্রাগ্রে যা প্রয়োজন তা হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত ব্যক্তি সৃষ্টি হবে এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরাই শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলবেন। তবে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করার অধিকার শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সবার আছে। তখন তাদের ভূমিকা হবে আলাদা আলাদা। যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন কোন ব্যক্তি অর্থবলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে দিতে পারেন। এই রকম অসংখ্য নজির আমাদের দেশে বিদ্যমান আছে।
যাকে নিয়ে এই ছোট্ট লেখনির সূত্রপাত করলাম তিনি রামুর সমাজ হিতৈষী দানশীল ব্যক্তি উঃ খিজারী বাবু। তিনি রম্যভূমি রামুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তার নাম লাওয়ে (সেনাপতি) পাড়া পরবর্তীতে মগপাড়া নামে খ্যাত যার বর্তমান নাম হাইটুপী। তিনি সম্প্রদায়গত ভাবে রাখাইন সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাঁর পিতা পাপ্রু সিকদার অত্যন্ত ধনী ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তারা ছিলেন পাঁচ ভাই ও দুই বোন। পাঁচ ভাই – মংহ্লা, খিজারী, দোপ্রং, মংহ্রী, হ্লাথোঁ। দুইবোন – আমো, ছেংপ্রু। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না। তবে এক বড় মাপের সওদাগর ছিলেন। জানা যায়, তিনি মায়ানমার (বার্মা), বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করতেন। অন্যান্য ধনী ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে ও কাজ করতেন। তখন এদের বলা হত জেনারেল মার্চেন্ট এন্ড কমিশন এজেন্ট। খিজারী বাবু অনেকের কাছে খিজারী দালাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে বর্তমানে যে অর্থে দালাল শব্দটি ব্যবহৃত হয় তিনি সেই পর্যায়ের দালাল ছিলেন না। তিনি নিজেও একজন বড় মাপের ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং সেই সূত্রে তিনি অন্যান্য সম্ভ্রান্ত সওদাগরদেরও প্রতিনিধি হিসেবে কজ করতেন মাত্র। তখনকার সময়ে মূলত রাখাইনরাই রামুতে নেতৃত্ব দিতেন। তখন রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রভাবশালী ধনী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। জানা যায়, খিজারী বাবুর চাইতে দোপ্রং বাবু অধিকতর ধনী ছিলেন। কালক্রমে উঃ খিজারী বাবু উপলব্দি করলেন রামুতে শিক্ষা বিস্তারে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেই ভাবনা সেই কাজ। তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পুরোদমে নেমে গেলেন। মায়ানমার আকিয়াব থেকে তিনি সিদ্ধ করা কাঠ এনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করলেন।
১৯১৪ সালের এক পর্যায়ে তিনি একক প্রচেষ্ঠা এবং অর্থানুকুল্যে রামুতে একটি কাষ্ঠনির্মিত দুতলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। জনশ্রুতি আছে যে, এটি কক্সবাজার জেলার সর্বপ্রথম উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’।
জানা যায়, তিনি সম্পূর্ণ এককভাবে উক্ত বিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানী তিনি নিজ তহবিল থেকে দিতেন। ক্রমে বিদ্যালয়ের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাল ফলাফল করতেন। তাঁর বলিষ্ঠ এবং যোগ্য নেতৃত্বে সুদীর্ঘকাল ধরে উক্ত বিদ্যালয় মান সম্মত পড়ালেখা এবং ফলাফলের বিচারে সর্ব্রাগ্রে ছিলেন। ফলে এর সুনাম জেলার (তৎকালীন মহকুমা) গন্ডি পেরিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তৎকালীন সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে। সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। তিনি খিজারী বাবুর সাথে দেখা করলেন এবং সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণের প্রস্তাব দিলেন। উনার প্রস্তাবের জবাবে খিজারী বাবু নাকি এক বাক্যে বলেছিলেন, “আই এম এ রীচ ফান্ড।” তিনি বাইরের কোন সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করবেন না। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন ততদিন একাই চালিয়ে নিয়ে যাবেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হত ১-৩ তারিখের মধ্যে। তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানী পৌঁছে দিতেন প্রতিমাসের ঠিক এক তারিখে।
রামু ক্রীড়া, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য, পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ উর্বর পুণ্যভূমি। এখানে রয়েছে হিন্দু, মুসলিম এবং বৌদ্ধ সহাবস্থানের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষার দিক দিয়ে অত্র অঞ্চল এখনো পিছিয়ে আছে। এর জন্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন বৈষম্যও সমানভাবে দায়ী। ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে রামু উপজেলা গঠিত। রামু উপজেলায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। অবাক হবার মত যে, রামু উপজেলায় একটিও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।
১৯১৪ সালে উঃ খিজারী বাবুর একক অর্থায়নে ২.৪৭ একর জমিতে রামুর একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে ‘রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ে বর্তমান ১৩০০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। ৩২টি দোকানের মালিকানা নিয়ে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ উক্ত বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে যে আর্থিক আয় আছে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করলে সরকারিকরণ করা হলেও সরকারের তেমন খরচ গুনতে হবে না।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শত বছর ধরে অদ্যাবধি সরকারিকরণ না হওয়া দুঃখজনক। এই ব্যর্থতা আমাদের সকলের।
নতুন বিহার উদ্বোধন উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বারের মত রামুতে আসলে এলাকাবাসীর হয়ে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, একুশে পদকে ভূষিত মাননীয় সত্যপ্রিয় মহাথের এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁর সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি কলেজ সরকারিকরণ করবে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তাঁর আশ্বাস পেয়ে রামুবাসী ধরে নিয়েছেন তাঁর কথার প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়টি অবশ্যই সরকারিকরণ করা হবে। তাঁর সরকার আবারও ক্ষমতায় এসেছেন। রামুবাসী এখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হউক।