শামসুল আরেফীনঃ
১৪ এপ্রিল ২০১১, ০১ বৈশাখ ১৪১৮ নিজ পরিবার ও কয়েকজন আত্মীয় নিয়ে কক্সবাজার গমন করলে পূর্ব পরিচিতি কবি মানিক বৈরাগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। এ সুযোগে তার নব প্রকাশিত সর্বপ্রথম কাব্য ‘গহীনে দ্রোহ নীল’ আমার হাতে ধরিয়ে দেন। কক্সবাজার থেকে থেকে ফেরার পর অনেকদিন নানা ব্যস্ততার কারণে গ্রন্থটি পাঠ করার অবসর হয়নি। সম্প্রতি পাঠ করে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করে মুগ্ধ হলাম। কবি হিসেবে সচেতনতার সাথে তিনি মনে রেখেছেন তার মৌলিক পরিচয় প্রথমত, তিনি নিজেেেক মনে করে দ্রাবিড়।
প্রান্তিক প্রান্তর শূন্য মোষের ডেরা
নিহত নদীর কাফনে ব্যস্ত শকুন বোবা মুখ
রাষ্ট্রসভা, ভাঙ্গা বাঁশি, উদলা রাখাল, ফিঙে দোয়েল
শূন্য চারণ
মহারাজ, কি দিয়ে সাজাই যমুনায় ফারাক্কা,
এখানে বারোমাস উদ্বাস্তু আসে জননী কারখানা
সৈকত তটে ব্যাৎসায়নের দালান গড়ে: সাগর দেখিনা
বিদ্যুৎরুপী বৃষ্টি, বিদ্যুৎ-বৃষ্টি যায় আসেনা
ব্যস্ততায় যায় দিন কিস্তি চিন্তায় চৈত্র-বৈশাখ বুঝিনা
সম্রাট আকবর তোমাদের বাঙালি করেছে?
আমি দ্রাবিড় (অনুভবে বৈশাখ, পৃ:৪৩)
অনন্তর, নিজেকে মনে করেন জন্মসূত্রে মসুলমান পরিচয়প্রাপ্ত এমন একজন, যিনি শৈশবে বুঝে না বুঝে ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করলেও এখন করেন না যেহেতু ধর্মের মধ্যে দলাদলি, তরিকা-দ্বন্দ্ব, রক্তারক্তি তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
জন্মেই শুনেছি আযানের ধ্বনি বেড়েছি মসুলমানের ঘরে
দেখেনি মুহম্মদ দেখিনি সাহাবা আরব ভূমি।
ধরণীর আলো বাতাস শস্য মৎস্য খাদ্য যত প্রকৃতির কীর্তি।
শৈশবে ঊষালগ্নে আদুরে ঘুম ভেঙ্গে পাঞ্জেখানায় কুরআন মুখস্ত করেছি
প্রচলিত নিয়ম বুঝেনা বুঝে মসজিদে নামাজ পড়েছি।
এখন পড়িনা নামাজ করিনা ধর্ম পালন না পাই যদি প্রশ্নের উত্তর
তুমিই তো একা নিরাকার আল্লাহ মুহাম্মদই শেষ নবী,তবে কেন?
তোমার ঘরে তোমার পতাকায় খুনে রাঙ্গায় আপন ভাইয়ের হাত তরবারি তোমারি
শিয়া সুন্নি ওয়াবি তর্কদ্বন্দ্বে সংঘাতে কুহেলিয়ার নীল জল রক্তে রাঙ্গায়
বুদ্ধির বিকাশে দেখেছি জেনেছি, পাইনি উত্তর
পীর আসে পীর যায়, তরিকা-দ্বন্দ্ব লেগে রয় মুরীদানের গায়
শ্যামল গাঁয়ের সহজ সরল মূর্খ মানুষ কষ্টে পেট চালাই, পীর কোথা পাই।
লালন আমার সার্বজনীন সর্বজ্ঞেয় মুহাম্মদই শেস নবী
আমি-ই খোদার খোদা-ই আমার দিব্য সৃষ্টি। (সরল কথা, পৃ:২৫)
‘গহীনে দ্রেহা নীল’-এ নিজের মৌলিক পরিচয় তুলে ধরেন এবং ৪০ এর অধিক কবিতা উপস্থাপন করেন মানিক। কবিতা সমস্তে আধুনিক কবি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কবিতাতো শব্দের খেলা। কবিতায় শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে ১৯৯৯ সালে কলকাতায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ গ্রন্থে বলা হয় ‘বাঙলা ভাষা এবং শব্দ এক নয়, ভাষার মধ্যে ধ্বনি আছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। তা না হলে অর্থহীন বৈদিক ¯্রােতধ্বনি ওই মর্যাদা পেতনা, ব্রজবুলির মতো আবেগ নিয়ন্ত্রিত, ব্যাকরণ বিস্মৃত ভাষা পেতাম না আমরা। আধুনিক কবিতার শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোনার্ক কিন্নরীর চিবুকে খোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে সাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন, ভাষার ভাষা পরম শব্দকে অভ্যর্থনা করে নেবেন বলে।’
মানিকের কবিতায় মানভাষার শব্দের পাশাপাশি কখনে সখনো যুৎসই বা লাগসই আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন- তেদুঁরের, কৈতর, ভুনা, বাইন্যা, ধেচ্ছুয়া, ভাদাইম্যা প্রভৃতি।
স্বপ্নের কোন ক্রান্তিকাল নেই সে আসবেই তেঁদুরের মতো….
তবুও তারা আসে যায় আমার জালালী কৈতুর বাক্বাকুম করে। (কুদোং গুহা, পৃ:৭)
২.
তোর প্রেমে পোড়া কলিজা ভুনা অনামিকা টুকরো
নানরুটি সাথে আমার উপাদেয় প্রাতরাস
মাংস ছিল্লা হাড়ে গহনা চুড়ি
বাইন্যা শিল্পে নতুন সংযোজন প্রেম, পৃ:১২)
বুভুক্ষ ধেচ্ছুয়া গিলে খায় স্বপ্ন সন্ধ্যা (সুবর্ণ সন্ধ্যায়, পৃ:৩৬)
আমি নষ্ট হবো বিক্রি হবো,একদা আওয়ামী ভাদাইম্যা ছিলাম (আওয়ামী ভাদাইম্যা, পৃ:৪৮)
পাহাড়ি ও আঞ্চলিক অনুষঙ্গ,এমনকি পুরাণ কথাও লক্ষ্যনীয় তার কবিতায়-
আমিও আদম সন্তান যীশুর রক্তাক্ত বুকে দেখি সবুজের ঐকতান।
জিবরাঈল আসেনা তাই স্বপ্ন দেখি কুদোং গুহায় । (কুদোং গুহা, পৃ:৭)
ফিরে চলো চিক্কপুদি
আমাদের অরণ্যে
যেখানে এখনো বন মোরগ ডাকে পেখম খুলে ময়ূর নাচে
বনফুলের বৈচিত্র শোভা পায়
সারি সারি বৃক্ষরাজি শিষ দেয় বনের পাখি
উচু নিচুগিরি পথে বন্য প্রাণীর ডাক শুনে
তোমাদের পথচলা (পাহাড়ি জনপদের মুক্তি ও একজন কল্পনা চাকমা পৃ:৮)
পূর্ণতিথিতে জোয়ার আসে হাওয়ায় হাওয়ায়
কার শিহরণ জাগে
মুহুরী পাড়ের মেয়ে, নদী ভাঙা মানুষের মিছিলে যেওনা
উত্তর পূর্বে সীতার পাহাড় (উজান গাঙে কৈ মাছের সঙ্গে, পৃ:৩৫)
দিব্যি আরাম করছে আরা’ফে আর আসবেনা বোররাক
মস্তিষ্কের মাজরা পোকা শুধুই আঁধার খোঁজে (সুবর্ণ সন্ধ্যায়, পৃ:৩৬)
নব্বইয়েই কবি হিসেবে মানিকের আত্মপ্রকাশ। তার পূর্বের অনেক আধুনিক কবির কবিতায় আঞ্চলিক শব্দও বিশেষ করে আঞ্চলিক অনুষঙ্গ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতো শব্দ সচেতন কবি ‘কিনু গোয়ালার গলি’ নামক বিখ্যাত কবিতায় ‘ভুতি’ (কাঠাঁলের ভুতি) নামে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেন। তিরিশের শক্তিধর পাঁচ কবি বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ খুুঁজে পাওয়া না গেলেও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আঞ্চলিক অনুষঙ্গ প্রবল। বলাবাহুল্য, অতিমাত্রায় শব্দ সচেতন এই পাঁচ কবি রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে মুক্তি হয়ে ভারতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি পুরাণ কথা পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন ধারণ করে কবিতায় নিজস্ব স্টাইল সৃষ্টিতে মনোযোগী ছিলেন। তাদের পরবর্তীতে জসীম উদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিতায় আঞ্চলিক শব্দের বা ভাষার প্রয়োগ ঘটান।
এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাচার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখথ সুনগান বানায় ইয়াদে
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।
‘এই মাতোয়ালা রাইত’ এক ফোঁটা কেমন অনল।
শামসুর রাহমানের ‘এই মাতোয়ালা রাইতদ কবিতার এ অংশে পুরান ঢাকার অনেক আঞ্চলিক শব্দ, কিংবা বলা যেতে পারে কবিতাটি পুরোপুরি ঢাকার আঞ্চলিক ভাষাভঙ্গির।
আরো পরে আরো অনেক কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ও আঞ্চলিক অনুষঙ্গ নিয়ে এগিয়ে আসেন, বিশ শতকের নব্বই দশকে এগিয়ে আসেন ব্রাত্য রাইসু, সাখাওয়াত টিপু, মুজিব ইরম, শামীম রেজা, সিরাজুল হক সিরাজ, শাহিদ হাসান প্রমুখ। এ দলের সিরাজুল হক সিরাজের কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ও আঞ্চলিক অনুষঙ্গ দারুন উপভোগ করার মতো।
শূন্য ঊরা ঘাড়াহীন আরাইল
বাঁশের বেড়ায় নারার ছাউনি ঘর
বিন্নিধানের ডোলে ইঁদুরে কুকুর মুচুর
গজিতে নেই চাউল, ঝিমুচ্ছে
নি:সঙ্গ ডলইন
উজাড় অরণ্য খরায় শুকিয়েছে হিমছড়ি
বে-মা ঝড়ে তছনছ মাদার বইন্যা, নিদানিয়া
আরাপারা গেরস্থালী
ওর্ঘুমা সোনার পাড়ার দিয়াকুল পুঁথি মাঝি
কেউ নেই কেউ থাকেনা
স্মৃতির মান্তকে জিঁয়াতা জারাইল ফুল
বাকবাকুম বাকবাকুম (রূপচাঁদা কঙ্কাল/সিরাজুল হক সিরাজ, ২০০৯)
নব্বইয়ের মাঝামাঝি এ দলের সাথে মানিকের সংযুক্তি। তার কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ও আঞ্চলিক অনুষঙ্গের ব্যবহার আমাদের আশ্বস্ত করে যে, স্বদেশি অথবা আধুনিক কবি হিসেবে একদিন তার অবস্থান পাকাপোক্ত হবে।
লেখক: কবি ও লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক।