তন্দ্রা নিদ্রাকালীন সময়ে মন সবচেয়ে সৃজনশীল থাকে ও ভালভাবে কাজ করে। তাই এখন যদি আমরা কৃত্রিমভাবে শিথিলায়ন (Relaxation) এর মাধ্যমে আমরা শরীর ও মনে বিশ্রাম ও তন্দ্রাকালীন আবহ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে ও ব্রেনওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি নেমে আসবে আলফা/থিটা লেভেল এ। আর ব্রেনওয়েভ কে আলফা/থিটা লেভেলে নামিয়ে আনতে পারলেই মেডিটেটিভ লেভেল তৈরি হবে। তখন আপনি প্রবেশ করতে পারবেন মনের আরো গভীরে। তাহলে আপনি আপনার সচেতন ও অবচেতন মনের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে যথাযথভাবে মন কে নির্দেশ দিতে পারবেন। ফলে আপনি আপনার মন কে আপনার ইচ্ছামত আপনার ও অপরের কল্যানের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।
আসুন আমরা জানতে চেষ্টা করি আমরা মেডিটেশন কেন করব।
মেডিটেশনের অনেক উপকারীতা আছে, এর কিছু কিছু দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব যা নিঃসন্দেহে আপনার মেডিটেশনে উৎসাহ বাড়াবে।
১. মেডিটেশন এর সময় শরীরের কার্যক্রম মনিটর ও নিয়ন্ত্রন করার দ্বায়িত্ব থেকে আমাদের ব্রেন ও মন অব্যাহতি লাভ করে। মন ও ব্রেন অপ্রয়োজনীয় শারীরিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রনের দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ায় প্রকৃতির গভীর ও সূক্ষ্ম স্পন্দন অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করে। নিঝুম ও নিস্তব্ধ পরিবেশে আমরা যেমন একটা মৃদু শব্দ ও শুনে ফেলি তেমনি মন ব্রেন যখন শিথিল ও শান্ত থাকে তখন প্রকৃতির সূক্ষ্ম স্পন্দন অনুভব করা সহজ হয়।
২. আমরা প্রায় শুনে থাকি, অন্ধদের মাঝে একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। এ কথার মধ্যে অবশ্যই সত্যতা আছে। কারন একটা ইন্দ্রিয় যখন কাজ করা থেকে বিরত থাকে তখন অন্য ইন্দ্রিয় গুলো তার ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য আরো বেশি সজাগ হয়ে ওঠে। এজন্য আমরা প্রায় দেখি সঙ্গীতের কোন সূক্ষ্ম সুর বোঝার/অনুভব করার জন্য সঙ্গীত বোদ্ধারা চোখ বন্ধ করে ফেলেন। আমরা নিজেরা ও কোন কিছু মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক সময় চোখ বন্ধ করি। এর ব্যাখ্যা হল, ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম বন্ধের সাথে সাথে মনের এনার্জি পুনর্বিন্যস্ত হয় এবং মনের উচ্চতর মাধ্যম গুলো (Higher faculties) কাজ শুরু করে। এর ফলে অন্যান্য ইন্দ্রিয় গুলো বাড়তি এনার্জি পেয়ে সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই নিয়মিত মেডিটেশন করলে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বাড়ে এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয় সজাগ হয়।
৩. মেডিটেশন এর সময় ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি হয়। আপনি নিজ মনের গভীরে প্রবেশ করেন। ফলে আমাদের শরীর ও মন হয় শিথিল এবং প্রশান্ত। আর শরীর ও মন শিথিল হলে সেখানে টেনশন বা দুশ্চিন্তা থাকবেনা। শরীর ও মন শিথিলায়নের এই বিশাল প্রাসাদ এই তত্ত্বের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। কারন, উত্তেজনার নিয়ম ই হচ্ছে কেউ শোয়া অবস্থায় উত্তজিত হলে উঠে বসে পড়ে, আর বসা থাকলে উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা ছোড়াছুড়ি বা লাফালাফি শুরু করে দেয়। তাই উত্তেজনার বিপরীত অবস্থান হচ্ছে হাত পা ছেড়ে শুয়ে পড়া। এ কারনে দেখা যায় শিথিল শরীরে কোন ধ্বংসাত্নক আবেগ কাজ করতে পারে না। নিয়মিত মেডিটেশনে এই ধ্বংসাত্নক আবেগ হ্রাস পেতে থাকে এবং এক সময় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৪. ডা. হার্বার্ট বেনসন দীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, শরীর শিথিল থাকা অবস্থায় হার্টবিট কমে, দেহে ব্যথা বা আঘাতের অনুভুতি হ্রাস পায়, উচ্চ রক্তচাপ কমে, দম ধীর গতি লাভ করে, রক্তে এড্রেনালিনের পরিমাণ হ্রাস পায়, রক্তে ল্যাকটেটের পরিমাণ কমে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, শরীর নিজে থেকেই রোগমুক্তির প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে।
৫. শরীর শিথিল অবস্থায় সচেতনতার পরিধি বৃদ্ধি পায়। শরীর সক্রিয় রাখার জন্য যে এনার্জি ব্যয় হত তা চলে আসে মনের আওতায় ফলে মন তা বেশি কাজে লাগাতে পারে তার উচ্চতর ক্রিয়া বা দক্ষতা বৃদ্ধিতে। তাই মনের চিন্তার ক্ষমতা (Thought Power) আগের চাইতে অনেকগুন বৃদ্ধি পায়।
৬. নিয়মিত মেডিটেশনে মনের উপর নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা বাড়ে। শিথিল অবস্থায় ব্রেনে আলফা ওয়েভ সৃষ্টি হয়। আর সাইকিক পাওয়ার ট্রেনিং এর একটি গুরুত্বপুর্ণ পর্যায় হচ্ছে ইচ্ছেমত ব্রেনে আলফা ওয়েভ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়া।
শিথিলায়ন, মেডিটেশন বা ধ্যানাবস্থায় অবস্থানের সুখই আলাদা। এটা এমন একটা সুখ ও আনন্দানুভূতি অনুভবের বিষয়, যা শব্দে বা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আপনি মনের যত গভীরে প্রবেশ করবেন, ততই প্রশান্তি পাবেন। আপনি এক সময় অবাক বিস্ময়ে দেখবেন টেনশন, দুশ্চিন্তা, রাগ-ক্ষোভ-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট বা ঘৃণা আপনার ধারে কাছেই আসতে পারছে না। টেনশন, দুশ্চিন্তা, রাগ-ক্ষোভে যে শক্তির অপচয় হত ব্রেন তখন সে শক্তিকে তখন কাজে লাগায় দেহের স্বাস্থ্য উদ্ধারে, মেধার বিকাশে, ভবিষ্যত পরিকল্পনার বাস্তবায়নে, চেতনার বিকাশে।
তো আসুন আমরা মেডিটেশনের জন্য প্রস্তুত হই।
নিচে থেকে মেডিটেশন এর অডিও ফাইল গুলো ডাউনলোড করে নিন।
১. শিথিলায়ন
২. ভয়
3. নেতিবাচক চিন্তা
৪. রাগ
৫. ক্ষোভ
৬. দুঃখ
৭. অনুশোচনা
৮. মনছবি
৯. মস্তিস্ক
১০. হও উন্নত শীর
মেডিটেশনের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে একটি নির্জন কক্ষ বা জায়গা বেছে নিন যেখানে আপনাকে কেউ বিরক্ত করবেনা। দরজা ভালভাবে বন্ধ করুন এবং মোবাইল/টেলিফোন সাইলেন্ট করে রাখুন।
ঢিলে-ঢালা পোশাক পরে আরাম করে চেয়ারে অথবা মেঝে তে আসন পেতে বসুন। অথবা বসে ও করতে পারেন। বসে করলে মেরুদন্ড ও ঘাড় সোজা করে দু হাতের তালু দুই হাটুর উপর রাখুন। হালকা ভাবে চোখ বন্ধ করুন। এরপর কম্পিউটার, মোবাইল/ডিভিডি/সিডি/এমপি থ্রি প্লেয়ার এর হেডফোন কানে লাগিয়ে (অথবা স্পিকার যেভাবে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন) প্লে করুন এবং যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয় সেভাবে মেডিটেশন করুন।
প্রথমদিকে মেডিটেশনের অনুভুতি এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে পারে। কারো কাছে মনে হতে পারে আপনি শুধু চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন, কিছুই অনুভব করতে পারেন নি। কারো শরীর ভারি লাগতে পারে, কারো প্রচন্ড গরম অথবা শীত লাগতে পারে। আবার কারো মুখে লালা আসতে পারে এমন কি গলা শুকিয়ে ও যেতে পারে। বসে মেডিটেশন করলে প্রথমদিকে অনেকের পিঠ, ঘাড় অথবা কোমর ব্যথা করতে পারে।
তবে এগুলোর যাই ঘটুক না কেন নিয়মিত করে যান, আপনি আস্তে আস্তে মেডিটেশনে পটু হয়ে উঠবেন।
তবে স্মরনে রাখুন, মেডিটেশন অডিও শুনে করুন আর বই পড়ে অথবা কোর্স করে করুন, আপনাকে যা বলা হয়েছে শুধু তাই কল্পনা করে যাবেন। যেরকম বলা হচ্ছে ঠিক সেভাবে অবলোকন বা অনুভব করতে পারলেন কিনা তা নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। আপনাকে যেভাবে কল্পনা বা অনুভব করতে বলা হচ্ছে, আপনি শুধু ভাবুন বা কল্পনা করবেন যে আপনি সেরকম অনুভব করছেন।
তাহলেই আপনি ধীরে ধীরে মেডিটেশনের গভীরে যেতে পারবেন।
মেডিটেশনের সুফল পেতে প্রতিদিন সকাল ও রাতে দু’বার মেডিটেশন করুন।
নিয়মিত মেডিটেশন আপনার জীবন থেকে সকল ধরণের নেতিবাচক চিন্তা-ধারণা, হতাশা দূর করে আপনাকে করে তুলবে আরো আত্নপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা এবং প্রো-এ্যাকটিভ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক অনন্য মানুষে।