মোহীত উল আলমঃ
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনাচার সাহিত্যকে পর্যালোচনা করলে তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে যেমন অনুধাবন করা যায়, তেমনি তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িকতাকে তত্ত্ব হিসেবেও আবিস্কার করা সম্ভব হয়। ধর্মকে বিজাতীয় ভাষায় প্রচারের ফলে ধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও জীবনবিরোধী একটি চর্চায় রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টার মধ্যে যে ভয়াবহ অমানবিকতা ছিল, তারই বিরুদ্ধে নজরুল শুধু যে আবেগজাত কাব্যিক প্রতিবাদ করে রুখে উঠেছিলেন তা নয়, তিনি টিনডেইল ও মালকেস্টরের মতো কৌশলীও ছিলেন এবং সচেতনভাবে ইসলামকে তাত্ত্বিকভাবে সাধারণ্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রচারের প্রয়াসও নিয়েছিলেন। ইব্রাহীম খানকে লেখা ওই একই পত্রে ইব্রাহীম খানের অনুরোধ যে নজরুল শুধু কবির ভূমিকায় না থেকে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাতেও থাকেন না কেন, এর উত্তরে নজরুল বিশদ লিখলেন যে, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি- বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে,- যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’ তারপর এক জায়গায় প্রশ্ন করছেন, ‘কিন্তু বন্ধু, এ কর্তব্য কি একা আমারই?’ নজরুল যে শুধু ধর্মীয় আবেগবশত ইসলাম ধর্ম ও কাহিনিবিষয়ক কবিতা ও সংগীত রচনা করেছিলেন তা নয়, তিনি এটাকে তাত্ত্বিক কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করেছিলেন। তার একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, কাঠমোল্লাদের জিগিরের ফলে যে ইসলাম বঙ্গদেশে আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছিল, সেটা ইসলামের মূল চেতনা বা প্রাণশক্তি- যা নজরুলের ভাষায়, ‘গণশক্তি, গণতন্ত্রবাদ, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ’ (১৯২৭ সালে অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খানকে লিখিত পত্র থেকে উদ্ধৃত)- তার প্রচারের ধারেকাছে তো ছিলই না, বরঞ্চ ছিল কেতাদুরন্ত পোশাকি মেকি ধর্মের প্রচার। ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে ইংরেজ রেনেসাঁ মনীষীরা, যেমন- উইলিয়াম টিনডেইল, রিচার্ড মালকেস্টর প্রমুখ ধর্মীয় ভাষা ও সাধারণ শিক্ষার ভাষা মাতৃভাষা তথা ইংরেজি হওয়া উচিত বলে আন্দোলন শুরু করলেন, তখন টিনডেইলের বাইবেলের হিব্রু এবং গ্রিক ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ পড়ে যেমন দ্রুত সাধারণ ইংরেজরা খ্রিষ্টধর্মের নিহিত বক্তব্য সরাসরি বুঝতে পারছিল, তেমনি মালকেস্টর, এলিয়ট প্রমুখের প্রচেষ্টায় ইংরেজি ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দ-অভিধান প্রকাশ হলো শুধু নয়, লাতিন ও ফরাসি ভাষাকে হটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষা দ্রুত ইংরেজি হয়ে উঠতে লাগল। এরই ফলে বলতে পারা যায় ক্ষণজন্মা নক্ষত্র শেকসপিয়ারের আবির্ভাব।
নজরুল শুধু ভাবাবেগের দ্বারা ইসলামী ভাবধারায় কবিতা বা গান লেখেননি, কিন্তু একটি তাত্ত্বিক কৌশল থেকে এসব রচনা করেছিলেন, যে কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষায় সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মকে বা ধর্মের বাণীকে সাধারণ্যের কাছে গল্পের মতো পৌঁছে দেওয়া। এ ধারণাটা মনের মধ্যে আমি অনেক দিন পুষে রাখলেও এটি সম্পর্কে আজকে লিখতে বসেছি, কারণ এর মধ্যে আমি আসানসোলে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গের একজন বিদুষী নজরুল অধ্যাপিকার একটি আলোচনা শুনে মনে হলো এ বিষয়ে, অর্থাৎ নজরুল যে ধর্মীয় চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্য ও গান নিছক কাব্যিক ভাবাবেগ থেকে রচনা করেননি, বরঞ্চ সেটা ছিল একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য তাত্ত্বিক কৌশল, সেটি বলে ফেলা দরকার। তার রাজনৈতিক লক্ষ্যটা ছিল অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিষ্ঠা। ইব্রাহীম খানকে লিখছেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, এ আমিও মানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ-অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে।’
অধ্যাপিকা যখন আলাপ করছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নিয়ে, মনে হলো যে তিনি নজরুলের শব্দ-ব্যবহার, ছন্দের প্রকরণ ইত্যাদি নিয়ে মাত হয়ে রইলেন কেবল, কিন্তু নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিদ্রোহী চেতনার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মোটেও আলোচনায় আনলেন না। বরঞ্চ দেখলাম তিনি ‘তাজি র্বোরাক্ আর উচ্চৈঃ শ্রবা বাহন আমার’ চরণটিতে কবীর চৌধুরী কেন ‘তাজি’র ইংরেজি ‘মাইটি’ করে ভুল করলেন, তার চুলচেরা বিশ্নেষণ করলেন অনেকক্ষণ, কিন্তু কোন প্রতিশব্দটি বেছে নিলে ঠিক হতো, সেটি আর বললেন না। র্বোরাক্ হলো পক্ষীরাজ, তাই তার বিশেষণ ‘তাজি’ নজরুল তেজদীপ্ত অর্থে ব্যবহার করেছিলেন বোধ হয় এবং সেদিক থেকে কবীর চৌধুরীর অনুবাদ ‘মাইটি’ আমার কাছে যথোপযুক্ত মনে হয়।
কিন্তু ব্যাপারটা বিশেষণ নিয়ে ঝগড়া নয়, ব্যাপারটা হলো নজরুল তার বিদ্রোহের বাহন হিসেবে অনেকগুলো মানুষ, জন্তু, পাখির যে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারই অন্যতম হলো এ পক্ষীরাজ ঘোড়াটি, যার আরবি শব্দ র্বোরাক্। অর্থাৎ, নজরুলের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাভাষী লোকদের আরবি সংস্কৃতির মিথ থেকে আহূত একটি পক্ষীরাজ সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া নয়, বরঞ্চ এ ছিল যে বাংলার আবহাওয়ায় বিদ্রোহী চেতনার স্ম্ফুলিঙ্গস্বরূপ ওই ঘোড়াকে বাংলাজাত করা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল লক্ষ্য সমাজ বদলানোর জন্য উদীপ্ত আহ্বান হলেও নজরুলের চেতনায় ইসলাম ধর্মকে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে মিশিয়ে এটাকে সহজ এবং বোধগম্য করার প্রচেষ্টা ছিল। ইংরেজ কবি টেনিসন যেমন গ্রিক থিমের ছদ্মাবরণে ভিক্টোরিয়া যুগের ইংরেজি সংস্কৃতি ও আবহের বয়ান করেছিলেন, তেমনি নজরুলও ধর্মীয় কাহিনি ও বয়ানের মাধ্যমে ধর্মকে বাঙালীকরণের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। এবং এ প্রচেষ্টার পুরোটাই ছিল ধর্মকে বিদেশি অবোধ্য ভাষার খোলস থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলা ভাষায় পেশ করা, যাতে সাধারণ মুসলমানের মনে ধর্মের মর্মবাণী ঢোকে।
এ প্রসঙ্গে নজরুলের কোরআন শরিফের কাব্য-আমপারা থেকে সুরাগুলো অনুবাদের কথা আমরা আনতে পারি। ‘সুরা ফাতিহার’ প্রথম দু’চরণের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ তিনি করলেন :’সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা,/ করুণা কৃপার যাঁর নাই নাই সীমা।’ কত সহজে এ অনুবাদ বাঙালির মরমে ধর্মীয় অনুভূতি জাগাবে! ‘সুরা ইখলাস’ অনুবাদ করছেন এভাবে :’বলো, আল্লাহ্ এক! প্রভু ইচ্ছাময়,/ নিস্কাম নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়।/ করেন না কাহারেও তিনি যে জনন,/ কাহারও ঔরসজাত তিনি নন।/ সমতুল্য তাঁর/ নাই কেহ আর।’ সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ‘আল্লা পরম প্রিয়তম মোর’ শীর্ষক কবিতায় লিখছেন, ‘আল্লা পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা তো দূরে নয়,/ নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়।’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় জোনাথন এডওয়ার্ডস নামক একজন ধর্মযাজক ‘সিনারস ইন দ্য হ্যান্ডস অব অ্যান অ্যাংরি গড’ শীর্ষক একটি সারমন প্রচার করেছিলেন, যাতে সৃষ্টিকর্তার একটি ভীতিকর ছবি প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বাসীদের মনে ভয় ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ঠিক ইসলামের প্রথাগত ধর্মপ্রচারের একটি অংশ হলো আল্লাহ সম্পর্কে একটি ভয়-জাগানিয়া চিত্রকল্প তৈরি করা। নজরুল আলোচ্য কবিতায় ভয় সম্পর্কে বলছেন, ‘কেমনে বলিব ভয় করে কিনা তাঁরে-/ যাঁহার বিপুল সৃষ্টির সীমা আজিও জ্ঞানের পারে।’ ভয়ের জায়গায় প্রেম নিয়ে আসলেন নজরুল, সঙ্গে আনলেন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বিরহ ও মিলনের কথা।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতার একটি বক্ষ্যমান বর্ণনা আসছে ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে। লিখেছেন :’নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু- তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’ এরই ভাবধারায় তার সাম্যবাদী কবিতাগুলো রচিত, যেখানে জাত ও জাতি ভেদ না মেনে মানুষের জয়গান গাওয়া হয়েছে। ‘সাম্যবাদী’ কবিতার শুরুটা নিরঙ্কুশ প্রদীপ্ত আহ্বানের মধ্য দিয়ে :’গাহি সাম্যের গান-/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ পরবর্তী কবিতা ‘মানুষ’-এ বলছেন সে যুগান্তকারী কথাটি, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’
ধর্মীয় ভেদাভেদের ওপরে মানুষের জয়গান গাওয়ার আরেকটি বড় সূত্র নজরুলের এ আধ্যাত্মিক প্রতীতি যে মানুষই তার ধর্মকে তৈরি করে নিয়েছে, ধর্ম মানুষকে তৈরি করেনি। দৃপ্ত কণ্ঠে ভর্ৎসনাসহকারে ওই একই কবিতায় বলছেন, ‘-মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব (‘আশরাফুল মাখলুকাত’) স্বীকার করার পাশাপাশি ধর্মের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে, যাকে আমরা সাধারণভাবে ‘লাকুম দিনিকুম ওলিয়াদিন’- ‘যার যার ধর্ম তার তার’ এ মতবাদটির মধ্য দিয়ে বলে থাকি, তারও একজন বড় প্রবক্তা ছিলেন নজরুল। এর কাব্যিক রূপায়ণ দেখি তার বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ শীর্ষক কবিতায়। উমরের সময় জেরুজালেম নগরী খ্রিষ্টানদের হাত থেকে মুসলমানদের করতলগত হয়। তিনি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য একটিমাত্র উট ও তার চালক সমভিব্যহারে যোজন যোজন মরুভূমির পথ পাড়ি দিয়ে মদিনা থেকে জেরুজালেমে পৌঁছান। সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল। আসর নামাজের সময় হলো। উমর জামায়াত পড়ার জন্য একটি খোলা জায়গা খুঁজছিলেন। তখন গির্জার পাদরি বললেন যে সন্ধি যেহেতু হয়ে গেছে, গির্জার প্রাঙ্গণেই ইচ্ছে করলে খলিফা উমর জামায়াত আদায় করতে পারেন। তখন নজরুলের চমৎকার কাব্যে খলিফা উমরের যে বয়ান কেন তিনি এ কাজটি করতে পারেন না, অর্থাৎ গির্জার প্রাঙ্গণে নামাজ আদায় করতে পারেন না, তার ব্যাখ্যা চমৎকারভাবে এসেছে। বললেন যে ওই কাজ করলে সব মুসলমান প্রজন্মান্তরে মনে করে নেবে যে মুসলমানেরা ইচ্ছা করলেই গির্জা বা মন্দিরে নামাজ পড়তে পারে। সে বিভ্রান্তি তো ছড়ান যাবে না। কবিতার ওই অংশটুকু উদ্ধৃত করি :
সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি’ শত্রু-গির্জা-ঘরে
বলিলে, “বাহিরে যাইতে হইবে এবার নামাজ তরে।”
কহে পুরোহিত, “আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার র্দ্গায়?”
হাসিয়া বলিলে, “তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ
ভাবিবে- খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি’
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি!
ইসলামের এ নহে ক ধর্ম, নহে খোদার বিধান,
কারো মন্দির গির্জারে করে ম’জিদ মুসলমান!”
কেঁদে কহে যত ঈসাই ইহুদী অশ্রুসিক্ত আঁখি-
“এই যদি হয় ইস্লাম- তবে কেহ রহিবে না বাকি,
সকলে আসিব ফিরে
গণতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে।”
এ কবিতাটি অসাম্প্রদায়িকতার একটি চমৎকার প্রকাশ এ জন্য যে এটিতে অসাম্প্রদায়িকতা বলতে মানবতাবোধকে বুঝিয়েছে, কিন্তু ধর্মহীনতাকে নয়। এ কবিতার মর্মার্থ যদি মুসলমানেরা আমলে নেয় তা হলে বোঝা যাবে অমুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করা কত গর্হিত কাজ। বাংলা ভাষার মাধ্যমে ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতাতত্ত্ব প্রচারের ক্ষেত্রে এ কবিতাটি একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে, অর্থাৎ ধর্মীয় আস্ম্ফালন নিবৃত না করলে কী হতে পারে তার একটা ঐতিহাসিক উল্লেখ করতে হয়। কাশ্মীরের শ্রীনগরের ডাল লেইকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ হযরতবাল মসজিদ। বলা হয়ে থাকে ওই মসজিদে রক্ষিত একটি কেশ বা চুল আমাদের পয়গম্বর নবী করিম (সা.)-এর। ১৯৬৩ সালে ওই চুলটি হঠাৎ মসজিদ থেকে খোয়া যায়। প্রতিক্রিয়ায় সারা ভারতবর্ষের মুসলমানেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। খোয়া যাওয়া চুলটি ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে উদ্ধার করা যায়, কিন্তু এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক অনেকগুলো দাঙ্গা ঘটে গেছে এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নোয়াখালীতেও দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এরই ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত ভারতীয় ইংরেজি লেখক অমিতাভ ঘোষ তার উপন্যাস ‘দ্য শ্যাডো লাইনস; (১৯৮৮) রচনা করলেন, যেখানে পুরান ঢাকার জিন্দাবাজারে একটি কল্পিত দাঙ্গায় নিহত একজন চরিত্র (জ্যাঠামশাই) ঠিক হযরতবাল মসজিদের চুল খোয়া যাওয়া ঘটনা থেকে সৃষ্ট হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার শিকার বলে উল্লেখ করা হয়। ঠিক এ সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে সরে থাকার জন্য নজরুলের আর্তি ‘উমর ফারুক’ কবিতায় ফুটে উঠেছে।
ইসলাম ধর্মকে আরবি ভাষার অচিনপুর থেকে বাঙালীকরণে নজরুল একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেটি হলো কবিতায় যথেচ্ছ আরবি-ফার্সির শব্দ প্রয়োগ করা। ফলে যেটা হলো, ইসলামের ভাবাদর্শ তার কিছু শাব্দিক এবং আলংকারিক স্ম্ফূরণসহ নজরুলের বাংলা কবিতার গাঁথুনিতে কেমন যেন সয়ে গেল। ‘মোর্হরম’ কবিতাটি এ কৌশলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
হলকুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে?-
আফ্তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে।
আসমান ভরে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ তার সংকলিত ও সম্পাদিত অতি সুপ্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ নজরুল’ গ্রন্থে এ কবিতাটির নিচে তর্জমা করে দিচ্ছেন, হলকুম অর্থ কণ্ঠ, তেগ অর্থ তরবারি, আফতাব অর্থ সূর্য।
আমার ধারণায় নজরুলের যেসব কবিতায় আরবি ও ফার্সি শব্দ হুড়মুড় করে মিশেছে, সেগুলোর অর্থ ও টিকা দেওয়া বর্তমান প্রজন্মের পাঠককে বোঝার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হতে পারে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি অত্যন্ত উঁচুদরের কবিতা হলেও এর মধ্যে বিদেশি শব্দ ও চরিত্রের উল্লেখের যথাযথ অর্থ ও টিকা দেওয়া এখন নজরুল-সম্পাদকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নজরুল এ কৌশল প্রয়োগে, অর্থাৎ বিদেশি শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয় বলে যৌক্তিকভাবে মনে করতেন। বস্তুত তার একটিমাত্র লেখায় যেটাতে তিনি খানিকটা চটা ভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে তার কাব্যভাবনা প্রকাশ করেছিলেন, যে প্রবন্ধের নাম ‘বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ’, সেখানে নজরুল দৃপ্তকণ্ঠে গুরুদেবকে বোঝাচ্ছেন এভাবে। প্রথমে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে। খুন হিন্দিতে হলো রক্ত আর বাংলায় হলো হত্যাকাণ্ড। নজরুল ‘মোহররম’ কবিতায় লিখলেন, “নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-/ ‘আম্মা! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।” নজরুল শুনলেন রবীন্দ্রনাথ তার খুন শব্দের ব্যবহার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জবাবে নজরুল উল্লিখিত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের কান তার বিরুদ্ধে কেউ কেউ বিষিয়েছে- এ সন্দেহ প্রকাশ করার পর বলছেন, “আমি শুধু ‘খুন’ নয়- বাংলায় চলতি আরও অনেক আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছি আমার লেখায়। আমার দিক থেকে ওর একটা জবাবদিহি আছে। আমি মনে করি, বিশ্ব কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানি ঢং আছে। ও-সাজে তাঁর শ্রীর হানি হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। স্বর্গীয় অজিত চক্রবর্তীও ও-ঢং-এর ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন।”
তার পরের লাইনটি একেবারে বাজিমাত বক্তব্য। বলছেন, “বাঙলা কাব্য-লক্ষ্মীকে দুটো ইরানি ‘জেওর’ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও খুবসুরতই দেখায়।”
তা হলে নজরুল তার চারিত্রিক সহজতায় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন- শুধু এ কথাটি বললে চলবে না। বলতে হবে যে তিনি বাঙালি মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য সচেতন প্রয়াস নিয়েছিলেন, নিয়েছিলেন বিভিন্ন কৌশল। তিনি প্রথম যেটা বুঝেছিলেন সেটা হলো ধর্মকে মাতৃভাষার মাধ্যমে চর্চা করতে হবে। দ্বিতীয়ত ধর্মের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে, থাকতে পারে পরমতসহিষ্ণুতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা সেটি গল্প এবং উপাখ্যান থেকে সাধারণ মানুষ বোঝার জন্য সাহিত্যরসমণ্ডিত করে প্রকাশ করতে হবে। তৃতীয়ত, মুসলমানের ধর্মগ্রন্থগুলো সাধারণ বাংলায় সুললিত তর্জমার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। চতুর্থত, বিদেশি শব্দ ও অলংকারের সহজ ও অবাধ মিশ্রণ বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ বই গরিব করবে না। এবং পঞ্চমত, নজরুল তার ব্যক্তিগত জীবনযাপন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন আক্ষরিক অর্থে অসাম্প্রদায়িকতার মাহাত্ম্য।
তার কণ্ঠশক্তি হারানোর প্রায় বছরখানেক আগে ১৯৪১ সালে প্রদত্ত ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ অভিভাষণে বলছেন, ‘হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম- অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম- আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর।’
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক তত্ত্বের ভিত্তিই হলো এ পরম সুন্দর।
সূত্র: সমকাল