অনলাইন ডেস্কঃ
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামির সাজা হবে কিনা, তা জানা যাবে ৩১ জানুয়ারি।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাঈল সেদিন এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন।
বুধবার রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক রায়ের এই তারিখ ঠিক করে দেন বলে এ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম জানান।
এর আগে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের চারদিনের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। গত রোববার দুপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
রায় ঘোষণার দিন ধার্যের আদেশ দেওয়ার সময় আদালতে অভিযুক্ত ১৫ আসামি হাজির ছিলেন।
আসামিরা হলেন: পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রিজনভ্যানে করে মামলার ১৫ জন আসামিকে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
পিপি ফরিদুল বলেন, বুধবার সকাল সোয়া ১০টায় আদালতের বিচারিক কার্যত্রুম শুরু হলে আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত তার মঙ্গলবারের অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মামলার মোট ১৫ আসামির আইনজীবীর যুক্তিতর্ক সম্পন্ন হয়।
বিচারিক কার্যক্রমে রাষ্ট্রপক্ষে দেশের বিশিষ্ট ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান যুক্তিতর্কে অংশ নেন।
আদালত থেকে বের হয়ে আইনজীবী রেজাউর রহমান বলেন, মামলার ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। এতে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে।
আদালত বিচারিক প্রক্রিয়ার সার্বিক দিক বিবেচনা করে ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করবেন এবং রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
এদিকে আসামির আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে আসামিদের আইনজীবীরা আদালতকে বলতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ আনীত অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা আদালতের কাছে ন্যায়-বিচার প্রত্যাশা করেছেন।
উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালতের কাছে সময় আবেদন করে কথা বলতে গিয়ে আসামি ওসি প্রদীপ আবেগতাড়িত ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন আসামির এই আইনজীবী।
এ প্রসঙ্গে রানা দাশগুপ্ত বলেন, “ওসি প্রদীপের আবেগের বিষয়টি তিনি কিছু বলতে চান। যদিও এ পর্যায়ে আসামির বলার কোনো আইনি সুযোগ নাই। তিনি (প্রদীপ) যা বলেছেন, এই বর্ণনার মধ্যেও আবেগ আছে।“
“তার (প্রদীপ) কথা ছিল একটাই, আমি (প্রদীপ) যদি কোনো অপরাধ করে থাকি; আমার শাস্তি হোক। কিন্তু আমি যদি কোনো অপরাধ করে না থাকি, বিনা অপরাধে আমার যেন শাস্তি না হয়।“
আসামিপক্ষের এ আইনজীবী আরও বলেন, “তিনি (প্রদীপ) আদালতের কাছে বলতে চেয়েছেন, যা আছে আপনার (বিচারক) কাছেই তথ্য-উপাত্ত আছে। আমি এই মামলা ঘটনার পরিকল্পনাকারীও নই, কোনো যোগসাজশী অবস্থানও আমার (প্রদীপ) ছিল না। কোনো চক্রান্তও আমার ছিল না। “
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করেন।
কিন্তু সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
সিনহা নিহতের ছয় দিন পর লিয়াকত আলী ও প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারী আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
ওই বছরের ২৪ জুন মামলার অন্য পলাতক আসামি টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ঘটনার প্রায় সাড়ে চার মাস পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫ কক্সবাজারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০২১ সালের ২৭ জুন সকল আসামির উপস্থিতিতে বাদী ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাইল মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ওইদিন সকল আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
একই বছরের ২৩ অগাস্ট মামলার বাদী অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ও সাক্ষীদের জেরা পর্ব। মামলায় মোট ৬৫ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন আদালতে। ৬৫ জনের মধ্যে ৯ জন সাক্ষী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মামলার অভিযোগপত্রে তালিকাভুক্ত মোট সাক্ষীর সংখ্যা ছিল ৮৩।
সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
সূত্রঃ বিডিনিউজ