অনলাইন ডেস্ক :
কোভিড মহামারীতে দুই বছর মন্দা কাটানো কক্সবাজারে এবার ঈদে সক্ষমতার চেয়ে বেশি পর্যটক সমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই হোটেল-মোটেলের অধিকাংশ কক্ষ আগাম ভাড়া হয়ে গেছে বলে এ ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গত বছর করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিধিনিষেধ থাকার পরও বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম হয়েছিল। আগে থেকে হোটেল-মোটেল ঠিক করে না আসায় সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কোনো কোনো পর্যটকের গাড়িতেও রাত কাটানোর ঘটনা ঘটেছে।
পর্যটকদের বরণ ও সেবা প্রদানে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউজসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এদিকে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটক আগমনের সম্ভাবনাকে ঘিরে সেবা প্রদান করতে এবং হয়রানি রোধে প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা বাহিনীও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে।
এবার ঈদের ছুটিতে অন্তত পাঁচ লাখ পর্যটক সমাগম এবং তাতে গত দুই বছরে পর্যটন খাতে ব্যবসায়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার অনেকটা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।
হোটেল-মোটল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোববার পর্যন্ত অধিকাংশ হোটেল-মোটেলের ৭০ শতাংশের মত কক্ষ আগাম ভাড়া হয়ে গেছে। সোমবার ও ঈদের দিনের (মঙ্গলবার) মধ্যে বাকি কক্ষগুলোও ভাড়া হবার আশা করা হচ্ছে। ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম ঘটবে মূলত ঈদের পরদিন বুধবার থেকে।
দেশে পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র সৈকত নগরী কক্সবাজার। বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতের পাশাপাশি পাহাড়, নদী ও মেরিন ড্রাইভের অপার সৌন্দর্য উপভোগে প্রতিদিনই ছুটে আসেন বিপুল সংখ্যক পর্যটক। ঈদের ছুটিতে পর্যটকের এ সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কয়েকদিন পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে কক্সবাজারের সবকটি বিনোদন কেন্দ্র।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও এখানে রয়েছে মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী ও পাটুয়ারটেকের পাথুরে সৈকত, কক্সবাজার শহরের অজ্ঞমেধা ক্যাং ও বার্মিজ মার্কেট, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক এবং রামুর বৌদ্ধ মন্দিরসহ নানা পর্যটন কেন্দ্র।
এই বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে কেন্দ্র করে তৎপর হয়ে ওঠে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও দালাল চক্রের লোকজন। এতে হোটেল কক্ষের ভাড়া ও খাবার রেস্তোরাঁসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার ঘটনায় বিরূপ সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ ও কটেজ রয়েছে অন্তত ৫২০টি। এসব আবাসিক হোটেলে কক্ষ রয়েছে ২০ হাজারের মতো; যাতে ধারণ ক্ষমতা এক লাখ ২০ হাজারের বেশি। আর ছুটির দিনগুলোতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক সমাগম ঘটায় অনেককে হোটেল কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সেই হিসাবে কক্সবাজারে প্রতিদিন আবাসিক হোটেলগুলোতে দেড় লাখের বেশি পর্যটক থাকা সম্ভব নয়।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ ও কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রমজান মাসে অল্প কয়েকটি বাদে কক্সবাজারের অধিকাংশ হোটেল এক প্রকার বন্ধ ছিল। এ সময়ে হোটেল কর্তৃপক্ষসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ধোয়া-মোছা ও রঙ লাগানোসহ নানা প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করেছেন, যাতে ঈদের টানা ছুটিতে আগত পর্যটকদের বরণ ও নির্বিঘ্ন সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়। এখন হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত পর্যটকদের বরণে।
“কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলসহ পর্যটকদের থাকার জন্য আবাসিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫২০টির বেশি। এতে নির্বিঘ্নে ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের। ইতোমধ্যে [রোববার পর্যন্ত] এসব আবাসিক হোটেলের ৭০ শতাংশের মত কক্ষ আগাম ভাড়া হয়ে গেছে। আশা করছি, হোটেলের বাকি কক্ষগুলো কাল (সোমবার) ও পরশুর (মঙ্গলবার) মধ্যে ভাড়া হয়ে যাবে।”
হোটেল মালিকদের এ নেতা বলেন, “এবার ছুটিতে কক্সবাজারে প্রতিদিন লক্ষাধিক পর্যটক সমাগম ঘটবে। টানা ছুটির এই দিনগুলোতে কয়েক লাখ পর্যটক সমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে।”
আবুল কাশেম বলেন, করোনা মহামারীর কারণে গত দুই বছর ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম ঘটেনি। এতে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন খাত ব্যবসায়িকভাবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি ঈদের টানা ছুটিতে কাঙ্ক্ষিত পর্যটক আগমনের সম্ভাবনাকে ঘিরে সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
তবে টানা ছুটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আগমনকে ঘিরে তৎপর হয়ে ওঠা এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে নজরদারির বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের দাবি জানান তিনি।
এদিকে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি হয়রানি রোধ ও সেবা প্রদানে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম।
রেজাউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঈদের টানা ছুটিতে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় সমুদ্র সৈকতসহ কক্সবাজারের সবকটি পর্যটন কেন্দ্রে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশপাশি আইন-শৃংখলা বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলোও কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ পোশাকধারী সদস্যদের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া সমুদ্র সৈকত, হোটেল-মোটেল জোন ও ঝাউ বাগানসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ছিনতাই প্রতিরোধ, ইভটিজিং ও পর্যটক হয়রানি রোধে সার্বক্ষণিক বিচ-বাইক, ওয়াটার-বাইক ও মোটরসাইকেলে পেট্রোলিং এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারপরও কোথাও আইন-শৃংখলা পরিপন্থি কোনো ঘটনার খবর পেলে তাৎক্ষণিক সাঁড়াশি অভিযানের প্রস্তুতি রয়েছে।
“নিরাপত্তার পাশাপাশি পর্যটক ও দর্শণার্থীদের তাৎক্ষণিকভাবে সেবা প্রদানের নিশ্চিয়তা দিতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ৬টি ‘ট্যুরিস্ট হেল্প ডেস্ক’ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি হেল্প ডেস্কে পর্যটকদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য রাখা হবে ‘ফাস্ট এইড বক্স’। এছাড়া প্রাণহানির মত অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সাগরের পানিতে নামা পর্যটকদের মাঝে চালানো হবে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা।”
ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও জানান, শুধু তা-ই নয়, সৈকতে ঘুরতে এসে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের উদ্ধার করে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তরের জন্য চালু থাকবে ‘চাইল্ড সাপোর্ট সেন্টার’ এবং পর্যটকদের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল, মানিব্যাগ বা অন্যান্য মালামাল উদ্ধারপূর্বক প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তরে রয়েছে ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড সেন্টার’। এছাড়া আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, আগামী কয়েকদিন গরমভাবাপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আগত পর্যটকদের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারির জন্য একটি ‘ওয়াচ টাওয়ার’ ও সাতটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান রেজাউল করিম।
অন্যদিকে টানা ছুটি ঘিরে বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের নিরাপত্তা ও হয়রানি রোধে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান।
আবু সুফিয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঈদের ছুটিতে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবা প্রদানে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া পর্যটক হয়রানি রোধ ও উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় চার জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মাঠে থাকবে চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সৈকতের লাবণী পয়েন্টের জেলা পর্যটন সেলের কার্যালয় সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে।
তারপরও পর্যটকদের কাছ থেকে কোথাও হোটেল কক্ষ ভাড়া ও খাবারের অতিরিক্ত দাম নেওয়াসহ যেকোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে মাঠ পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
সূত্র : বিডিনিউজ