আজ ৯ আগস্ট; আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের মতো এ দেশের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত ৫০টি জাতির ৩০ লাখ আদিবাসীও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। এবার জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য- ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ এবং বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা।’
বৈচিত্র্যময় প্রথাগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ দেশের আদিবাসী জাতিগুলো। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নাচ, গান, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, অলংকার, বাদ্য-বাজনা প্রভৃতি। আরও রয়েছে লোকসাহিত্য। এ ছাড়া চাষ পদ্ধতিতেও আদিবাসীদের রয়েছে ভিন্ন জ্ঞান, যা মূল জনগোষ্ঠীর কৃষি পদ্ধতি থেকে ভিন্ন।
মূলত আদিবাসী নারীরা হচ্ছেন নিজ সংস্কৃতির ধারক-বাহক। নারীরা তাঁদের সন্তানদের জন্মের পর থেকে নিজস্ব ভাষা, প্রথাগত ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করান। লোককাহিনি, গান শুনিয়ে মায়েরা তাঁদের শিশুদের ঘুম পাড়ান। এতে শিশুদের এসব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এ ছাড়া নিজস্ব পোশাক সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও আদিবাসী নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নিজস্ব তৈরি পোশাক দৈনন্দিন জীবনে পরিধান ও বুননের কাজ করে। উৎসবগুলোতে বাদ্য-বাজনার সঙ্গে গান, নাচ পরিবেশন করেন নারীরা। এসব দেখে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও প্রথাগত ঐতিহ্যগুলো চর্চা এবং সংরক্ষণ করতে উৎসাহিত হয়।
কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই আদিবাসী নারীরা ভালো নেই। কারণ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসী নারীদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত আছে। সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার পীরগাছা মৌজার আমতলীতে আদিবাসী নারী কৌশলা নকরেক এবং তাঁর তিন ভাইবোনের ২ একর ৪০ শতক কৃষিজমিতে পর্যটকদের জন্য কৃত্রিম লেক খননের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আদিবাসী এবং বন বিভাগের লোকজনের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বন বিভাগের দাবি, জমিটি সংরক্ষিত বনভূমির অন্তর্ভুক্ত। তাই সেখানে প্রবেশাধিকারে নিষেধ করে গত ৬ জুলাই একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিন জমির মালিক আদিবাসী নারী কৌশলা নকরেক কয়েকজন শ্রমিকসহ জমিতে চাষ করতে গেলে দোখলা রেঞ্জের রেঞ্জার ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে তাঁর অফিসের কয়েকজন গিয়ে চাষাবাদে বাধা দেন। জমির মালিক বন বিভাগের লোকজনের বাধা উপেক্ষা করে চাষ চালিয়ে গেলে টহল পুলিশ এনে চাষাবাদ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বন বিভাগের লোকজন আদিবাসীদের গুলি করার হুমকি দেন বলে অভিযোগ আছে। জমির মালিক কৌশলা নকরেক একজন গারো নারী। গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। তাই তিনিই এ জমির মালিক। বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর নানির পরে তাঁর মা এবং এখন তিনি এ জমির মালিকানা পেয়েছেন। মধুপুরের আদিবাসীদের আশঙ্কা, কৌশলা নকরেকের জমিতে লেক বাস্তবায়ন হলে শুধু তাঁর ও তিন ভাইবোনের জমিই নয়; তাঁর জমির পাশে মোট ১৩ মান্দি নারীর জমিও লেকের পানিতে ডুবে যাবে।
মধুপুর বনের গারোরা সর্বপ্রথম ১৮৭৮ সালে তাঁদের ধানি নিচু জমি ভারতীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধমে রেজিস্ট্রিভুক্ত করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে আদিবাসীদের জমির মালিকানা ঝুঁকিগ্রস্ত হতে থাকে। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সালে মধুপুর বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা এবং ১৯৬২ সালে ৪০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে জাতীয় উদ্যান করার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল পার্ক বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রাখে। সরকার ১৯৮৪ সালে গেজেট নোটিফিকেশন করে মধুপুর এলাকায় বসবাসরত অধিকাংশ আদিবাসী জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি আদালতে তোলা হলে ভূমি সেটেলমেন্ট অফিস গারোদের কাছে সংরক্ষিত জমির মালিকানার দলিলাদিও শনাক্তকরণে অসম্মতি প্রকাশ করে এবং আদিবাসীদের রেজিস্ট্রিকৃত জমিগুলো খাসজমি হিসেবে ঘোষণা করে। এর পর থেকে বন বিভাগের লোকজন মধুপুরের আদিবাসীদের বহিরাগত আখ্যা দিয়ে নানাভাবে দমন-পীড়ন শুরু করে। রাষ্ট্র দ্বারা এভাবে আদিবাসীদের অধিকার অস্বীকৃতির কারণে আজ বন বিভাগ কখনও লেক খননের নামে, কখনও ইকোপার্কের নামে, কখনও সামাজিক বনায়নের নামে, কখনও বন সংরক্ষণের নামে; আবার কখনও বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ ও রাবার বাগানের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও উচ্ছেদ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। শুধু মধুপুরের আদিবাসীরা নন; উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, পাহান, মুণ্ডা, পাহাড়িয়াসহ অন্য আদিবাসীদের জমি ভূমিগ্রাসীরা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা দখল করছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি দিনাজপুরে স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক আদিবাসীদের ৭৭ দশমিক ৬১ একর জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী পইমণি চিরানের বাড়ির আঙিনার শাকসবজির বাগান কেটে ফেলে বন বিভাগের লোকজন। অথচ এই শাকসবজির বাগানই ছিল তাঁর জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। এ ছাড়াও গত জুলাই মাসে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়িতে আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা এবং ৩৭টি আদিবাসী বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে মধুপুরে বন বিভাগ কর্তৃক কৌশলাসহ অন্যান্য মান্দি নারীকে ভূমিহীনে পরিণত করার অমানবিক প্রকল্প বন্ধ করার জন্য বর্তমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে; সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সেসবের হোতাদের শাস্তি দাবি করছি। সর্বোপরি আদিবাসী নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
রাখী ম্রং: মানবাধিকারকর্মী