তোফায়েল আহমদ
যাকে বলে একজন নিরীহ মানুষ তিনি। মানবতাবাদী, নির্লোভ এবং নিরহংকারতো বটেই। লোভ লালসার সম্পূর্ণ উর্ধে থেকেই জীবন কাটিয়ে গেলেন। কারো সাথেই শত্রুতা ছিল না। অসাধারণ মানবিক গুণাবলী ছিল তার। শিশু থেকে বুড়ো -সবার সাথে মেলামেশায়ই একাকার ছিলেন এই লোকটা। সত্যি একজন ভাল মানুষের যাই যাই থাকা দরকার তার সবই ছিল তার কাছে। এই মানুষটির নাম আবদুল হামিদ শমশের বেলাল।
কৈশোরে দুষ্ট প্রকৃতির জন্য নয়, বাস্তবে বাবার চাকুরির কারনেই কুমিরার বিখ্যাত সেই বন্দি স্কুলটিতে তাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালে কুমিল্লা স্কুল থেকে এস,এস,সি পরীক্ষার পরই কক্সবাজার কলেজে লেখাপড়া তার। মূলত ইন্টারমিডিয়েটের পর থেকেই বেলাল ভাই সংবাদপত্রে শুরু করেন লেখালেখি। এক সময় ঢাকার জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র দেশবাংলা থেকে এক সময়ের প্রভাবশালী এবং বিখ্যাত দৈনিক বাংলার বাণীর কক্সবাজার জেলা সংবাদদাতা হিসাবে নিয়োগ পেলেন তিনি। শুরু করলেন সাংবাদিকতা। কিন্তু সাংবাদিকতায় শেষ দিন পর্যন্ত লেগে থাকলেন না তিনি। শেষ বয়সে এক প্রকার একাকী সময় কাটিয়েছেন।
সাংবাদিক আব্দুল হামিদ শমসের বেলাল
বেলাল ভাই বয়সে আমার ৭/৮ বছরের বড় হলেও সম্পর্কে ছোট-বড় পার্থক্য তেমন ছিলনা। সাংবাদিকতায় আমাদের মধ্যে ছিল চমৎকার সম্পর্ক। তিনি ছিলেন সত্যি একজন পরোপকারি মানুষ। কারো সাথে বিরাগভাজন হয়ে সংবাদ পরিবেশনের কাজ থেকে তিনি ছিলেন বেশ দুরে। এরকম সাংবাদিকতাকে তিনি পছন্দ করতেন না। রাগ-অনুরাগ এবং মান-অভিমান মানুষের থাকেই। তেমনি বেলাল ভাইয়েরও ছিল। আমরা বলতাম বেলাল ভাইয়ের ‘নাকে ভীষন গোস্বা।’ পত্রিকায় প্রেরিত সংবাদ ছাপা না হলে পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের সাথে গোস্বা করে গোঁ’ ধরে বসতেন। নাকের গোস্বায় বেশ ক’দিন পার হত। আবার স্বাভাবিক হতেন।
আমরা দীর্ঘদিন যাবত কক্সবাজার জেলার সর্বপ্রথম সংবাদপত্র্র দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় নিয়মিত কাজ করেছি। পত্রিকা সম্পাদক আমাদের সকলের মুরুব্বি আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম সম্পর্কে বেলাল ভাইয়ের সাথে মামা-ভাগ্নে। এই মামা-ভাগ্নের মধ্যেও কত মধুর সম্পর্ক। আজীবন প্রগতিশীল চিন্তাধারার এই লোকটি যতদিন সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন মানুষের কল্যাণমূলক খবরকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। স্থানীয় পত্রিকায় যত বেশি সম্ভব স্থানীয় সমস্যাদির কথাই লিখে গেছেন তিনি। সব সময় মুখে হাসি থাকত তার। শিশুদের ভালবাসতেন বেশি। শিশুপ্রেমি এই লোকটির কত স্মৃতি জড়িত রয়েছে তা এত স্বল্প সময়ে কিভাবে বলি। আমার দুই সন্তান তাদের প্রিয় বেলাল আংকেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে রীতিমত আৎকে উঠেছে। অগনিত চকলেট আর খেলনার কথা কিভাবে ভুলবে ওরা !
কক্সবাজার প্রেস ক্লাবেও এক সময় আমাদের বেশ ভাল সময় গেছে। বেলাল ভাই দলমত নির্বিশেষে সবার সাথে ভাল সর্ম্পক রাখার ক্ষমতা রাখতেন। এ কারণেই ১৯৮৮ সালের দিকে বেলাল ভাইকে প্রেস ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বও দিয়েছিলাম আমরা। চমৎকার ভাবে সামাল দিয়েছিলেন-যত ঝামেলা। সারাজীবন কাটিয়েছেন কাউকে কষ্ট না দেয়ার নীতি নিয়ে। এ নীতিতে শেষ সময়েও ছিলেন অটল।
গত ক’দিন ধরে অসুস্থতা বোধ করছিলেন তিনি। নিজেই ভুগছিলেন কিন্তু কাউকে বলছেন না। কেননা তার জন্য পরিবারের সদস্যদের কষ্ট করতে হবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তবুও শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা এক প্রকার জোর করেই হাসপাতালে নিয়ে ভর্ত্তি করান চিকিৎসার জন্য। সেখানেই গতকাল বুধবার তিনি পাড়ি জমান পরপারে। আর এমন একজন সদা হাস্যরসের মানুষটিকেই আমাদেরও বিদায় জানাতে হল।
বাবা-মা’র কনিষ্ট সন্তান ছিলেন তিনি। আহা পরিবারের কতইনা আদর-যত্ন। রাতে যতক্ষণ ঘরে না ফিরতেন মা না খেয়েই বসে থাকতেন। এক সময় মা ক্লান্ত হয়ে যান বয়সের ভারে। মা ডাক দেন বেলাল ভাইয়ের ঘনিষ্ট বন্ধু পিন্টুদাকে (জেষ্ট্য সাংবাদিক প্রিয়তোষ পাল পিন্টু)। বেলাল ভাইকে বিয়ে করতে বলা হল। বেলাল ভাইয়ের জবাব-‘না’। সেই বাবা-মা একে একে সকল বন্ধু-বান্ধবের পর এবার আমাকেই ডাকলেন-বেলাল ভাইকে বিয়ে করার চাপ দিতে। আমি বেলাল ভাইয়ের অনেক জুনিয়র এবং আমি বিবাহিত। বিয়ে করার জন্য আমিও বহু বলাবলি করেছি কিন্তু বেলাল ভাই বিয়েকে ‘না’ করলেন। আর সেই না-তেই আমাদের সকলের প্রিয় বেলাল ভাই ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ এশার নামাজের পর ঐতিহ্যবাহি বদর মোকাম মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে চির শায়িত হলেন তারই বাবার পাশে।
বেলাল ভাই-আপনি শান্তিতে থাকুন চিরকাল। রাব্বুল আলামীনের নিকট-এই কামনা।