বৌদ্ধধর্মে অষ্টমী, অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা তিথি পালনের প্রথা আছে। তবে পূর্ণিমা তিথি সর্বাধিক প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। কারণ বুদ্ধের সমগ্র জীবনকে ঘিরে যেসকল স্মরণীয় এবং তাৎপর্যবহ ঘটনাবলী ঘটেছে সেসকল ঘটনাবলী কোন না কোন পূর্ণিমা তিথি কেন্দ্রিক ঘটনা। যেমন বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সিদ্ধার্থের জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের ঘটনা ঘটেছে বলে বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে পরিচিত। আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি হতে আশি^নী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একটানা তিনমাস ধরে বর্ষা উদযাপন করেন। আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে প্রবারণা উদযাপনের মধ্য দিয়ে সেই বর্ষাব্রত শেষ হয়। তাই আশি^নী পূর্ণিমার অপর নাম প্রবারণা পূর্ণিমা নামে পরিচিত। ভাদ্র মাসের ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জীবদ্দশায় এক বানর বুদ্ধকে মধুপিÐ দান দিয়ে পূজা করেছিল। সেই ঘটনার সূত্রধরে ভাদ্র পূর্ণিমা মধুপূর্ণিমা নামে পরিচিত।
তদ্রুপভাবে মাঘ মাসের পূর্ণিমা বলে মাঘী পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। এবছর ৫ ফেব্রæয়ারি মাঘী পূর্ণিমা পালিত হবে। শুভ মাঘী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের অন্যতম একটি তাৎপর্যময় পূর্ণিমা তিথি। মাঘী পূর্ণিমা তিথিকেও কেন্দ্র করে বুদ্ধের জীবদ্দশার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই পূর্ণিমা দিনেই বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের বৈশালীর চাপাল চৈত্যে তথাগত বুদ্ধ নিজেই তার মহাপরিনির্বাণ লাভের দিনক্ষণ ঘোষণা দেন। যাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা হয় আয়ু সংস্কার। আয়ু সংস্কারের পরিবর্তে অনেকে আয়ু বিসর্জনও বলে থাকেন। বৌদ্ধরা পুণ্যময় এই দিনটিকে অষ্টশীল পালন, বুদ্ধপূজা দান, সংঘদান, বিহারে ধর্মীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আলোকসজ্জা, হাজার প্রদীপ প্রজ্জলন, দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত উপাসনাসহ বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন।
এই দিনে বুদ্ধ নিজের মহাপরিনির্বাণ লাভের দিন ঘোষণার পাশাপাশি আরো একটি ঘটনা হলো মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে প্রাতিমোক্ষ উদ্দেশ তথা উপদেশ দিয়েছিলেন। প্রাতিমোক্ষ হলো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিত্য প্রতিপালনীয় বিনয়-বিধান সম্বলিত একটি গ্রন্থ। বিনয় পিটকের বিভিন্ন গ্রন্থ হতে চয়ন করে উক্ত গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে।
মাঘী পূর্ণিমা দিনে বুদ্ধ নিজের আয়ু বিসর্জনের ঘোষণা দেয়ার পেছনেও কারণ আছে। বৌদ্ধধর্মে মারের কথা উল্লেখ আছে। মার সবসময় বুদ্ধ শাসনের বিরুদ্ধে থাকে। কারণ জগতে বুদ্ধ আবির্ভূত হলে মারেরা তেমন সুবিধা করতে পারে না। মার শাসন খর্ব হয়ে পড়ে। মানুষ পাপকর্মে রমিত হওয়ার চাইতে পুণ্যকর্মে বেশি রমিত হন। কারণ বুদ্ধ প্রতিনিয়ত সত্ত¡গণকে ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য, সার-অসার সম্পর্কে হিতোপদেশ দিয়ে থাকেন এবং মানুষের ভেতরের সত্ত¡াটাকে জাগিয়ে তোলেন। যার ফলে জগতে মার নামক অপশক্তি অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারেনা। তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তাই মার (অপশক্তি) সবসময় বুদ্ধ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সিদ্ধার্থের গৃহ ত্যাগ, বুদ্ধত্ব লাভ, বুদ্ধত্ব লাভের পরপর সকল সময়ে মার বুদ্ধের পেছনে পড়ে থেকেছিল। কিন্তু তখন সুবিধা করতে পারেনি। বুদ্ধ প্রত্যেকবার তথাগতের এখনো পরিনির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময় হয়নি বলে কারণ দেখিয়ে মারকে ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু শেষবার বুদ্ধ যখন বৈশালীর চাপাল চৈত্যে অবস্থান করছিলেন তখন মার পুণরায় বুদ্ধকে মহাপরিনির্বাণ লাভের প্রার্থনা জানালে বুদ্ধ মারের প্রার্থনা স্বীকার করে নিলেন। মারকে নিশ্চিত করলেন যে, তিনি বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত হবেন। আয়ু বিসর্জনের সে দিনটা ছিল শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথি।
বস্তুত, মাঘী পূর্ণিমা দিবসটি বৌদ্ধদের কাছে খুব একটা আনন্দের দিন নয়। এটা বুদ্ধকে হারানোর একটি দিন। কারণ বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করলেও এর সূচনাটা হয়েছিল মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে শুভ মাঘী পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই।
লেখক, সভাপতি, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার।