অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য ও দুর্গন্ধে হুমকির মুখে পড়েছে রামু উপজেলার প্রাণকেন্দ্র চৌমুহনী। দায়দায়িত্বহীন ভাবে চৌমুহনী স্টেশনের ব্যবসায়ীরা ব্যস্ততম সড়কের পাশে যত্রতত্র ফেলছে অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য, পলিথিন, খাবারের উচ্ছিষ্ট। এতে পানি নিষ্কাশন পথ (ড্রেন) ও সড়কের পাশে পায়ে হাঁটাপথ চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। অপচনশীল বর্জ্য ও দুর্গন্ধে চৌমুহনীর পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। জনদুর্ভোগ এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, বণিক সমিতি বা পরিবেশ অধিদপ্তর কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এ সব বর্জ্যের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকুরীজীবী, ক্রেতা সহ পথচারীদের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রোববার বিকালে রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রামু খিজারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, উপজেলা পরিষদ, রামু কেন্দ্রীয় কালী মন্দির, স্কুল মসজিদ সংলগ্ন রামু-কক্সবাজার সড়কের উভয় পাশে দেখা যায় অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য, পলিথিনের স্তুপ। দুর্গন্ধযুক্ত এই স্তুপে বেশি ছড়িয়ে আছে শপিং মল ও স্টোর ব্যবসায় কাপড় প্যাকিং-এ ব্যবহৃত পলিথিন, প্লাস্টিকের পানির বোতল ও প্লাস্টিকের ব্যাগ। অপচনশীল এসব বর্জ্যের কারণে সড়কের পাশে পানি নিষ্কাশন পথ (ড্রেন) ও পায়ে হাঁটা পথে চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের ড্রেন পলিথিনে ভরাট হয়ে গেছে। ড্রেনের কাঁদাযুক্ত পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
রামু চৌমুহনী বণিক সমবায় সমিতি সুত্রে জানা গেছে, রামু চৌমুহনী স্টেশনে শতাধিক মার্কেটে ৯০০ থেকে ১০০০ দোকান রয়েছে। তৎমধ্যে সাত শতাধিক দোকান মালিক ব্যবসায়ী রামু বণিক সমবায় সমিতির সদস্য। ব্যবসায়ীরা যত্রতত্র দোকানের ব্যবহৃত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে রামু চৌমুহনীর পরিবেশ দুষণ করছে।
এ বিষয়ে রামু চৌমুহনী বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, দোকানের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে রেখে পুড়িয়ে ফেলতে বনিক সমিতির পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে। মার্কেট মালিক ও দোকান মালিক-কর্মচারীদের সর্তক করার পরও যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা অব্যাহত রয়েছে। আবারও ব্যবসায়ী বনিক সমিতির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হবে, যত্রতত্র না ফেলে নির্ধারিত একটি স্থানে প্লাস্টিক বর্জ্য যেন পুড়িয়ে ফেলে।
বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা জানান, চৌমুহনী স্টেশনের কোথায়ও নির্ধারিত ভাবে বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা নেই। তাই তারা বাধ্য হয়ে চৌমুহনী স্টেশনের সড়কের পাশের বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলছে। এমনকি বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলতে মার্কেট মালিকরাও কোন সংরক্ষিত স্থান রাখেন নি।
যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে সড়কের উভয় পাশের পানি চলাচলের ড্রেন ভরাট হয়ে আছে দীর্ঘ বছর ধরে। ড্রেনের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরায় ওই স্থান দিয়ে হেঁটে চলাচলও দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এতে পানিবাহিত নানা রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে।
রামু চৌমুহনীর বাসিন্দা নাইক্ষ্যংছড়ি হাজি এম এ কালাম সরকারি কলেজের সিনিয়র প্রভাষক নীলোৎপল বড়ুয়া বলেন, নিয়ন্ত্রণবিহীন বিশৃঙ্খল স্টেশনে পরিণত হয়েছে রামুর চৌমুহনী। স্বেচ্ছাচারিতায় যে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করছে এ স্টেশনকে। চৌমুহনীকে কেন্দ্র করে যারা ব্যবসা করছে, উপার্জন করছে। তারাই চৌমুহনীর পরিবেশ নষ্ট করছে, দুষণ করছে ও জানজট সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যথাযত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা ও প্লাস্টিক বর্জ্য। রামু চৌমুহনীর আশপাশের বাসিন্দা, পথচারী, গাড়ির যাত্রী, ব্যবসায়ী এবং পণ্য কিনতে আসা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে প্লাস্টিক দূষণ।
রামু উপেজলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো থাকে। এ সব রঞ্জক কারসিনজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গবেষণায় মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত হয়েছে।অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মানুষ ও প্রাণী দেহের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
তিনি বলেন, যেকোন বর্জ্যই সঠিক ভাবে নিস্কাশন করা জরুরি। নালা নর্দমায় প্লাস্টিক জমে থাকলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানি জমে থাকার কারনে মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে যায়। ফলে ডেংগু ও ম্যালেরিয়ার মত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। প্লাস্টিক সহজে নস্ট হয়না এবং মাটিতে মিশেনা। এরকারনে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতাকে কমিয়ে দেয়। অনেক সময় প্লাস্টিকের বর্জ্য নদী বা জলাশয়ে জমে থাকে। পানি দূষিত হয় এবং মাছের জন্যও ক্ষতির কারন হয়।
রামু প্রেসক্লাব সভাপতি নীতিশ বড়ুয়া বলেন, যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে পরিবেশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে রামু চৌমুহনীর স্বয়ং ব্যবসায়ীরা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে, প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতাও দরকার। আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র ফেলা যাবে না ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য। নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক ‘সুজন’ রামু উপজেলার সভাপতি মাস্টার মোহাম্মদ আলম বলেন, রামুতে প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নাই। প্লাস্টিক বর্জ্য বোতল, চালের বস্তা, পলিথিন ব্যাগ অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। দোকানে প্লাস্টিক, পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহার এবং কারখানাগুলোতে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানান তিনি।
‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে’ এ প্রতিপাদ্যে আজ সোমবার বিকাল ৫টায় রামু চৌমুহনী স্টেশনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পথসভা অনুষ্ঠিত হবে। গ্রীন এনভায়রণমেন্ট মুভমেন্টের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য পথসভার স্লোগান ‘সবাই মিলে করি পণ বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’, ‘গাছ লাগিয়ে যত্ন করি সুস্থ প্রজন্মের দেশ গড়ি’। রামু চৌমুহনী স্টেশনের এ পথসভায় পরিবেশ সচেতন সকল স্তরের মানুষকে উপস্থিত থাকতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন, গ্রীন এনভায়রণমেন্ট মুভমেন্ট কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কায়সার মাহমুদ।