সাদিয়া নাসরিন:
রামু থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সাম্প্রতিক সাঁওতালপল্লী; মানুষ পুড়েছে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। উত্তম বড়ুয়া থেকে রসরাজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট; একটি ফটোশপ, একটি জনসভা, উচ্ছেদ অভিযান, কিছু মানুষ আর দেয়াশলাই। এরপর সেই একই চিত্র, সেই একই আগুন, ভাঙচুর আর মাটিতে গড়ানো মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সেক্যুলারিজম। খোলা আকাশের নিচে ধুলোয় লুটোয় ভূমিপুত্র সাঁওতাল, যাকে ভগবান মানুষ করেনি। সম্প্রীতি এখানে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় মহাশূন্যে। সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকার যে শত বছরের অহঙ্কার এই বাংলাদেশের ছিল, তাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, মানবতা পোড়া আগুনের লেলিহান শিখায়। তবু কেউ কেউ সব পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিশ্বাসটুকু হারিয়ে গেছে, তা কোন মূল্যে পোষাবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা বসিয়ে কি সম্প্রীতি টেকানো যায়?
রামু বৌদ্ধ বিহার ও পল্লীতে হামলা, জ্বালাপোড়াও এবং লুটপাটের ঘটনায় আমরা অসংখ্য বৌদ্ধমূর্তি, শত শত বছরের প্রাচীন পুরাকীর্তি হারিয়েছি। বুদ্ধের সময় তালপাতায় লেখা মহামূল্যবান পুথিগ্রন্থ এবং বিভিন্ন ভাষার অসংখ্য ত্রিপিটক খণ্ড পুড়েছে, যা কোনও কিছুর বিনিময়েই পুষিয়ে দেওয়া যায়নি, যাবেও না। যদিও পোড়া ভিটে মাটির ওপর উঠেছে নতুন ঘর, কাঠের বদলে দালানের বৌদ্ধ মন্দির, পুড়ে যাওয়া মূর্তির বদলে চকচকে সোনারঙ বুদ্ধমূর্তি। হয়তো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নাসিরনগরে ও নতুন ঝকঝকে দোতলা দালান মন্দির হবে। দেব-দেবী হবে সেই মন্দিরে। কিন্তু দেবী কি আদৌ আসবে কোনও দিন সে মন্দিরে? রামুর সেই চকচকে দালানগুলো কি এতদিনেও মন্দির হয়ে উঠতে পেরেছে? দেবী-দুর্গা-বুদ্ধ কি ইট-লোহার মন্দিরে থাকে, নাকি বিশ্বাসে?
বিচারহীনতার এই দেশে, এই পুষিয়ে দেওয়া রাজনীতির দেশে, বিচ্ছিন্ন (!) ঘটনার এই দেশে, পারস্পরিক দোষারোপের এই দেশে রামু সহিংসতার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। উত্তম বড়ুয়াকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফল, রংপুরে আহমদিয়া জামাতের লোকজনের ওপর হামলা, বাঁশখালীতে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দির জ্বালানো, মাটিরাঙ্গার তাইন্দংয়ে নৃ-গোষ্ঠীর ওপর হামলা, সাঈদীর বিচার নিয়ে সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের বাড়ি-মন্দির জ্বালানো এবং সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর হয়ে গাইবান্ধার সাঁওতালপল্লী। লক্ষণীয় যে, যেসব স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে, সেসব এলাকায় ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক যোগাযোগ ও শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফজলুল হক আমিনীর মৌলবাদী ঘাঁটি। তারাই গতবছর একইভাবে আক্রমণ করে শত বছরের ঐতিহ্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সাংস্কৃতিক নিদর্শন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন এগিয়ে এসেছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে, কখনও কখনও নিষ্ক্রিয় থেকেছে। কোনও সময় প্রশাসনের সরাসরি অংশগ্রহণেই হামলা হয়েছে।
এবার কিছু নির্মোহ সত্যবিশ্লেষণ হোক। আমরা প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানকার মানুষ নাকি ঐতিহ্যগতভাবে অসাম্প্রদায়িক! কিন্তু যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা আমরা উঁচু গলায় বলি, সে সম্প্রীতি কি এখন আছে এই দেশে? না ধর্মীয়, না জাতিগত কোনও রকমের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি আমাদের ব্যক্তিগত চেতনায় বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে?
অপ্রিয় সত্য হচ্ছে—মেজরিটি-মাইনরিটির বিভাজনে থাকা জনগোষ্ঠী এই দেশে বড়জোর সহাবস্থান করে, কিন্তু সম্প্রীতি বরাবরই ‘ফিল ইন দ্য ব্লাঙ্ক’। আমাদের প্রতিটি কাজে, আচরণে, পরিকল্পনায় এই শূন্যস্থানের ছাপ স্পষ্ট।
গণজাগরণ মঞ্চের সহকর্মী মারুফ রসুলের একটা কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, ‘এ দেশে লেখকরা লেখার সময় ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; প্রকাশকরা ছাপার আগে ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; গণমাধ্যম তাদের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার সময় ভাবে, এটা মুসলমানের দেশ; রাজনৈতিক নেতারা বক্তৃতা দেওয়ার আগে ভাবেন, এটা মুসলমানের দেশ; সরকার সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর আগেও ভাবে, এটা মুসলমানেরই দেশ। এমনকি ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মাবলম্বীরা, আমাদের সমাজব্যবস্থায় যারা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে পরিচিত; তারাও এই ভেবেই জীবনযাপন করেন যে, বাংলাদেশটা আদতে মুসলমানেরই দেশ’।
সাম্প্রদায়িকতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ-এই কথাটি মেনে নিতে না পারলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে, ধর্মীয় আগ্রাসনকে নির্মূল করা যাবে না। আমাদের মেনে নিতে হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-রাজনীতির নানা ভেল্কিবাজি থেকে ‘দ্বি-জাতী তত্ত্ব’ নামে এক অদ্ভূত নিদান দিয়ে পাকিস্তান নামের যে সাম্প্রদায়িক সংক্রমণ এ দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি আমরা। কখনও জাতি ও জাতীয়তাবাদের নামে, কখনও ধর্মের আবরণে সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজ, সাহিত্য ও রাষ্ট্র জীবনে সরবে উপস্থিত। স্বাধীন বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিত্র আঁকা হয়েছে বহু বছর ধরে সঙ্গোপনে, সাবধানে।
৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজাম ইসলামসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে মৌলবাদী রাজনীতি শুরু হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়ে ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ ঢুকিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িকতার সংক্রমণ ছড়িয়ে দিল শিক্ষা ব্যবস্থায়।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের টার্গেট করে তাদের পেছনে বিনিয়োগ করতে শুরু করলো। একটি প্রজন্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পড়েনি; ‘পাক হানাদার’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ এই শব্দগুলোর ইতিহাস জানেনি। এভাবে তৈরি হলো একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এই বুদ্ধিজীবীদের চক্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার কাছে সুকৌশলে আমাদের মগজের বেচাকেনা হয়ে গেছে সেই শিশুকাল থেকে।
তাই আজকে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দেখে এত হতভম্ব হওয়ার ভান করার কিছু নেই; এই আমরাই এরা। হিন্দু বাড়ির পূজার প্রসাদ আর মুসলমান বাড়ির ঈদ সেমাই খেলে বা প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস ওড়ালেই অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না। আমরা সবাই সাম্প্রদায়িক। আমরা জ্ঞানে-অজ্ঞানে জানি ও মানি আমরা মেজর, ওরা মাইনর। তাই এক পক্ষ অন্যপক্ষকে অশ্লীল শব্দে ডাকি।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ।
উৎস: বাংলা ট্রিবিউন।
*************************************************************************************************
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।আমাদের রামু -এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য আমাদের রামু কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।