দৈনিকশিক্ষা:
নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উদ্বেগ ছিল সব সময়েই। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারছে না বলে সমালোচনাও হচ্ছে।
তবে সরকারের গবেষণা প্রতিবেদনিই বলছে, কেবল শিক্ষার্থীরই নয় বরং মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষকই এখনও সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। এদের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ শিক্ষকের অবস্থা খুবই নাজুক।
এ ধরনের শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্রও তৈরি করতে পারেন না। বাকিরা এ সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদনে’ এ তথ্য উঠে এসেছে। সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। মাউশির মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন ইউনিট প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বরিশাল অঞ্চলের ৫৪৩ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। দেখা যায়, ৫৪৩ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৭ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করেন ১৭ টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ৪৯৯ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা।
কুমিল্লার ৪২৬ টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে দেখা যায়, ১৩৬ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রশ্ন করতে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নেন। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেন ৬৪ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। নিজেরা প্রশ্ন করতে পারেন ঢাকা বিভাগে এমন প্রতিষ্ঠানের হার ৬৫ ভাগ, ময়মনসিংহে ৪৫ ভাগ, সিলেটে ৫৪ ভাগ, চট্টগ্রামে ৫০ ভাগ, রংপুরে ৫২ ভাগ, রাজশাহীতে ৮০ ভাগ, খুলনায় ৬১ ভাগ, বরিশালে ৫ ভাগ, কুমিল্লায় ৫৩ ভাগ। সারাদেশের হিসাবে এ সংখ্যা ৪৫ ভাগ।
২০০৮ সালে দেশে মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। এ লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৮ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। ২০১০ সালে বাংলা এবং ধর্ম বিষয়ে এ পদ্ধতিতে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। কিন্তু নতুন এ পদ্ধতি প্রবর্তনের আট বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষকরা এখন পর্যন্ত তা আয়ত্ত করতে পারেননি। এমন পরিস্থিতির কারণে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে বলা হয়েছে, সৃজনশীলে প্রশ্ন করতে না পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও কেড়ে নেয়া হবে।
সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের এমন করুণ চিত্র সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষকরা বলছেন, মূল সমস্যা প্রশিক্ষণের ঘাটতি। সরকার থেকে এ বিষয়ে সব শিক্ষককে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। যে ক’জন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাও পর্যাপ্ত নয়। মাত্র তিনদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমদিন ও শেষদিন আসা-যাওয়ার মধ্যে কেটেছে। সেই হিসেবে প্রশিক্ষণ হয়েছে মাত্র একদিন। সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য যে কটি উদ্দেশ্য মোটা দাগে প্রচার করা হয় তার অন্যতম হচ্ছে শিক্ষার্থীদের গাইড বই ও কোচিং-নির্ভরতা কমানো। কিন্তু বর্তমানে কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও গাইড নির্ভর হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি খোদ পাবলিক পরীক্ষায় হুবহু গাইড বই থেকে প্রশ্ন করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ধরা পড়েছেন ৫ শিক্ষক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
দক্ষতায় পিছিয়ে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী: বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীর ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী দক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে রয়েছে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। মাউশির প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষতা অর্জনে মধ্যম অবস্থায় রয়েছে ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে বেশি দক্ষতা অর্জন করেছে। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের ৩২ জেলার ৫৫ উপজেলার ৫২৭ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যষ্ঠ শ্রেণীর ১৫ হাজার ৮১০ ও অষ্টম শ্রেণীর ১৫ হাজার ৮১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের দক্ষতার মান যাচাইয়ের জন্য বাংলা, গণিত এবং ইংরেজী বিষয়েকে বেছে নেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণীর গণিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অনেক নিচে অবস্থান করছে ২৩ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মধ্যম অবস্থায় এবং অধিক দক্ষতা অর্জন করেছে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ইংরেজীতে ২৯ শতাংশ অনেক কম দক্ষতা অর্জন করেছে, ৫৬ শতাংশ মধ্যম এবং ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অধিক দক্ষতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে বাংলায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনেক কম দক্ষতা অর্জন করেছে, ৬০ শতাংশ মধ্যম এবং মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অধিক দক্ষতা অর্জন করেছে।
ছাত্র এবং ছাত্রীর মধ্যে কে কোন বিষয়ে দক্ষতায় এগিয়ে ও পিছিয়ে রয়েছে তাও এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণীর গণিতে ৮০ শতাংশ ছাত্র এবং ৭৫ শতাংশ ছাত্রী গড় শিখন মান অর্জন করেছে। ইংরেজীতে ছাত্র এবং ছাত্রী উভয়ই সমান ৭১ শতাংশ দক্ষতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে বাংলায় ৬৮ শতাংশ ছাত্র এবং ৭০ শতাংশ ছাত্রী দক্ষতা অর্জন করেছে। আবার অষ্টম শ্রেণীর গণিতে ৬২ শতাংশ ছাত্র এবং ৫২ শতাংশ ছাত্রী, ইংরেজীতে ৫০ শতাংশ ছাত্র, ৪৯ শতাংশ ছাত্রী এবং বাংলায় ৫৫ শতাংশ ছাত্র এবং ৫৪ শতাংশ ছাত্রী গড় শিখন মান অর্জন করেছে।