দীর্ঘদিন পর হলেও এবার জাতীয় পর্যায়ে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে অপারেশন সার্চলাইট নামে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পরিচালিত অভিযানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান)।
৪৬ বছর আগে পাকিস্তানের চালানো সেই গণহত্যার খবর ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থেকে গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধমে। দি টেলিগ্রাফ, দি টাইমস, দি সানডে টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও সংবাদ সংস্থা বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার খবর প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানের বর্বরতা সম্পর্কে জানায়।
বিশ্বে যত গণতহ্যার ইতিহাস আছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যার জঘন্য নজির আছে, তার মধ্যে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কতটা বর্বর ছিল সেই রাতের হত্যাযজ্ঞ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেই সময়ে প্রকাশিত খবরে তার বিবরণ পাওয়া যায়।
২৫ মার্চে ঢাকায় অবস্থানকারী বিদেশি সাংবাদিকদের বাইরে বের হতে নিষেধ করে পাকিস্তান সরকার। তখন হোটেল কন্টিনেন্টালে আরো কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে ছিলেন দি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। নিষেধ উপেক্ষা করে হোটেলের ছাদে উঠে পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
রাত ১১টা নাগাদ রাস্তায় নামে অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। ট্যাংক ও কামানের গর্জনে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সাংবাদিকরা বুঝতে পেরেছিলেন- ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। সেই কালরাতে রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকা। আহত-মৃত্যুমুখী মানুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল ঢাকার আকাশ।
সেই কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সারা রাত পাকিস্তানের নারকীয় তাণ্ডবে ঝরে যায় প্রায় ৭ হাজার প্রাণ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। ২৬ মার্চ সকালে এক মৃত্যুপুরী ঢাকা দেখা যায়। সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং।
ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সাইমন ড্রিংয়ের খবর প্রকাশিত হয় দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। খবরের শিরোনাম ছিল ‘TANKS CRUSH REVOLT IN PAKISTAN : 7,000 slaughtered, homes burned’। মূলত এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার খবর প্রথম জানতে পারে বিশ্ববাসী।
সাইমন ড্রিং তার প্রতিবেদন শুরু করেন এভাবে : ‘ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও ভয়ার্ত শহরের নাম। পাকিস্তানি বাহিনীর ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টার নির্মম গুলিবর্ষণে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে বিশাল এলাকা এবং স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামের নির্মম পরিণতি ঘটেছে।’
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ দি টাইমস পত্রিকায় গণহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয়-
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পুড়ে যাওয়া লাশ এখনো তাদের বিছানার ওপর পড়ে আছে। এক বিশাল গণকবর খুব দ্রুত ভর্তি হয়েছে…)
(মিশেল লরেন্ট, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একজন চিত্রগ্রাহকের বরাতে, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় চলাচল করছিলেন)
দি টাইমসের প্রতিবেদনের শুরুতে লেখা হয়, ‘দুই দিন, দুই রাত ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে শুধু ঢাকা শহরেই মারা গেছে ৭ হাজারের বেশি মানুষ। আমেরিকার সরবরাহ করা এম-২৪ ট্যাংক, আর্টিলারি ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বৃহস্পতিবার রাতে হামলা চালায়, শহরের বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়।’
১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল দি টাইমস (লন্ডন) পত্রিকায় ২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে সাংবাদিক লুইস হেরেনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর শুরুতে বলা হয়- ‘পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে শেষ করা, যা ভালোভাবেই সম্ভব হাসিল হয়েছিল।’
১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের দি নিউ নেশন পত্রিকায় গণহত্যা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে চলমান এই হত্যাযজ্ঞ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’।
২৫ মার্চের গণহত্যার খবর গুরুত্বসহকারে উঠে আসে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের খবরে। গণহত্যা নিয়ে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান থেকে আটজন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষে যায় এমন সংবাদ তৈরি করে। এ দলে ছিলেন পাকিস্তানের মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক মাসকারেনহাস। পাকিস্তানে ফিরে ১৮ মে তিনি লন্ডনে চলে যান। তিনি সান ডে টাইমসের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করলে পত্রিকাটি তা গ্রহণ করে।
সান ডে টাইমসের প্রথম পাতায় প্রকাশিত মাসকারেনহাসের প্রথম প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’। প্রতিবেদনের শুরুতে তিনি লেখেন, ‘মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারছে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা।’ এই প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর নজরে আসে এবং পাকিস্তানের চালানো গণহত্যা সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পায় কূটনৈতিক বিশ্ব।
১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চেহারা আজকের মতো ছিল না। বিদেশের খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশে দুই-তিন দিন লেগে যেত। সেই সময়ে ২৫ মার্চের কালরাতের খবর ২৭ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল, মে ও জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।
‘DECCA BREAKS WITH PAKISTAN’ শিরোনামে ২৭ মার্চ একটি খবর প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার দি এজ পত্রিকা। ওই বছর ২৮ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমস তিনটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদগুলোর শিরোনাম ছিল- ‘Army expels 35 foreign newsmen from Pakistan’, ‘Artillary used’ ও ‘Toll called high’ ।
বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ দি টেলিগ্রাফ সম্পাদীয়সহ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ দিন সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এ বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি ও দি এজ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে।
২৫ মার্চের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্বসহকারে সংবাদ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্য করলেও দেশটির সংবাদপত্রে বর্বরতার এই চিত্র ফুটে ওঠে। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকায় সেই ভয়াবহ গণহত্যার ইতিহাস বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ম্লান হয়ে পড়েছে। কিন্তু ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হওয়া এখন সময়ের দাবি।
সূত্র: রাইজিংবিডি।