প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে এখন থেকে আমরা স্বাধীনভাবে বলতে পারব ২৫ মার্চ আমাদের ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’। দীর্ঘ সময় পরে হলেও জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের রাষ্ট্রীয় ঘোষনা এল এবার। অপেক্ষা এবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। মহান জাতীয় সংসদে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার ১৮ মিনিটের সচিত্র একটি প্রতিবেদন সংসদে সংরক্ষিত বড় পর্দায় দেখানো হয়। কিছুক্ষণের জন্য পুরো সংসদ যেন নির্বাক হয়ে রইল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার চোখ মূছছেন।
গত ১১ মার্চ সরকারের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জাসদের ফেনী ১-আসনের এমপি শিরীন আখতারের উত্থাপিত এক প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ওই দিনকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক। আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।’ এরপর কেবিনেট বৈঠকে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
দীর্ঘ দুই যুগ আগে থেকে উঠা কোন দাবি দুই যুগ পরে এসে তার স্বীকৃতি পেল। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের দাবি এই প্রথম নয়। ১৯৯৩ সালে জননী জাহানারা ইমাম সর্বপ্রথম এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন।
জেনারেল এরশাদ শাসনের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়। সেই থেকে এই পর্যন্ত যতগুলো সংসদ নির্বাচন হয়েছে তার সবকটিতে হয় আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপি নির্বাচিত হয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ এই দুই রাজনৈতিক দল বার বার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র শুরু হবার পরপর ১৯৯৩ সালে জননী জাহানারা ইমাম বিষয়টি রাষ্ট্রের সামনে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু সকল সরকারের আমলে বিষয়টি বার বার উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক আগে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে হলে বহির্বিশ্বের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই অপেক্ষারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু দিনটিকে জাতীয় দিবস ঘোষনা করতে চাইলে আমাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন কিংবা স্বীকৃতি কোনটির প্রয়োজন ছিলনা। এটা আমাদের অভ্যন্তরীন বিষয়।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহিদ দিবস ঘোষনা করতে বাংলাদেশ কারো সমর্থন কিংবা স্বীকুতি আদায়ের জন্য অপেক্ষা করেনি। বরং ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ঘোষনা করায় পরে ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইউনেস্কো এর গুরুত্ব বিবেচনা করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করে। ২০০০ সাল থেকে সারাবিশ্বে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এতে বিশ্বময় বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছে। ঠিক একইভাবে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস প্রতিষ্ঠিত হতে পারত।
তাহলে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ঐক্যের কোন ঘাটতি ছিল নাকি দলীয় উদাসীনতা ছিল? এই প্রশ্ন আমরা এখন তুলতেই পারি।
মহান সংসদে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধী গলা উচিয়ে স্বয়ং নিজে বলে নাকি বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই! যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের বিচার নিয়ে রাজনীতি হল। যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে জাতীয় ঐক্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে না উঠায় বিচার শুরু করতে সুদীর্ঘ চার দশক সময় লেগে গেল।
তবে এখন এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ৭১-এ বাংলাদেশের কিছু মানুষ রাজাকার, আলবদর, আল শামস এবং শান্তি কমিঠির সাথে মিলে পরিকল্পিতভাবে এদেশের মানুষের উপর হত্যা, নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার, ঘর-বাড়ি পুড়ানো, অপহরণ, গুম, শারীরিক নির্যাতন, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরণের মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে।

৭১-এ বাংলাদেশে ২৫ মার্চ রাতে বিনাযুদ্ধে নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের উপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। এটা সবার জানা কথা। তথ্য প্রমাণ সবই আছে। এই রকম হত্যাযজ্ঞ এদেশের মাটিতে আর হয়নি। এখানে গণহারে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। তাই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করতে আমাদের বিন্দুবিসর্গ দ্বিধা নেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ৭১-এ ত্রিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন দেশের কোন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক তুলেন। কিন্তু তাঁর চোখের সামনে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিন অর্থ্যাৎ প্রায় ৯ মাস ধরে যে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলা যায় এ দাবি তিনি তুলেননা। গণহত্যা কি কেবল সংখ্যার মাপকাঠিতে পরিমাণযোগ্য?
ইংরেজি ‘জেনোসাইড’ শব্দটির বাংলা অর্থ গণহত্যা। যার অর্থ বিশেষ কোন জনগোষ্ঠি বা ধর্ম, বর্ণ ও বিশ^াসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকান্ড, আক্রমণ ও পীড়ন এবং সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’-এ এই সংজ্ঞা স্বীকৃত আছে।
১৯৪৮ সালে অবিভক্ত ভারত প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হল। ১৯৬৫ সালে ভারত থেকে পাকিস্তান আলাদা হল। দুইটি রাষ্ট্র আলাদা ভূখন্ড পেল। কিন্তু এদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলনা। পাকিস্তানের কাছে এদেশের মানুষ সবসময় বিশেষ কোন ভাষার বিশেষ কোন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের মত গণ্য হয়েছে। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে কত কি হল। না, দমন-পীড়ন, শোষণ, নির্যাতন, অধিকারহরণ ক্রমশ বেড়েছে কিন্তু কমেনি। অবশেষে পাকিস্তান বেছে নিল গণহত্যার পথ। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে এই এক রাতেই অন্তত ১ লাখ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে।
মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করা যেমন বিস্ময়কর তেমনি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এত সংখ্যক মানুষ হত্যার নজিরও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
তবে বিশ শতকের পূর্বে এর চেয়ে বড় গণহত্যা একটা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানিতে, যা বিশ্বে স্বীকৃত ‘হলোকাস্ট’ নামে। সেই গণহত্যায় জার্মানির নাৎসি বাহিনীর হাতে ষাট লাখ মানুষ, যার অধিকাংশই ইহুদি, নিহত হয়েছিল।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান মতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৬০ দিনে দৈনিক গড়ে ৬০০০ মানুষ হত্যা করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতেই পরিকল্পিত পন্থায় ব্যাপক এই হত্যাকান্ড, আক্রমণ, পীড়ন এবং নির্যাতন চালিয়েছিল। তাদের বর্বর আক্রমণ থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কেউ রেহায় পায়নি।
৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের জনগণের উপর গণহারে যে পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালিয়েছে তা যদি গণহত্যা না হয়, তাহলে গণহত্যার অপর সংজ্ঞাটি কী?
দেরিতে হলেও সরকার ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষনা করায় আমরা মনে করি জাতি এই সিদ্ধান্তকে সকল দলমত এবং সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সাদরে অনুমোদন করবেন। লক্ষ লক্ষ শহিদদের আত্মত্যাগের প্রতি এটাই আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন এবং হত্যাকারীদের প্রতি সরব প্রতিবাদ।
প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ৷১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বরে প্রথমবারের মত জাতিসংঘে গণহত্যা প্রতিরোধ ও এ সংক্রান্ত শাস্তি বিষয়ক প্রথাটি গৃহীত হয়। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হল গণহত্যা বিষয়ক প্রথাটির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ ও সম্মান করা। এটি জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এ-ও স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের নিজ জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব আছে। গণহত্যার উস্কানি বন্ধ করা ও গণহত্যা ঘটলে তা প্রতিরোধ করা এই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশ পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস ঘোষনার প্রস্তাব এবং দাবি জানাতে পারে। সুযোগ এখনো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকার জাতিসংঘে যেতে পারে, মানবাধিকার কমিশনে বিষয়টি তুলতে পারে। এছাড়া নেদারল্যান্ডসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে বিষয়টি তুলতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করতে পারে।
মোদ্দাকথা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে যা যা করণীয় সবকিছুই করতে হবে। এই বিষয়ে জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার এই সরকারের দিকে শেষপর্যন্ত তাকিয়ে থাকবে।
“জয়তু বাংলাদেশ”।