আল মাহমুদ ভূট্টো:
রামু উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পাহাড়ে বসবাস করছে অন্তত দশ হাজার পরিবার। জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে এসব পরিবারের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র পূনর্বাসন বা প্রশাসনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,নির্বিচারে গাছ এবং মাটি কাটার ফলে পাহাড় ও টিলাগুলো দিন দিন ভারসাম্য হারাচ্ছে। ফলে মুষলধারে বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণ হানির সংখ্যাও কম নয়। গত সাত বছরে রামু উপজেলায় পাহাড় ধ্বসে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ সেনা সদস্যসহ অন্তত ২০ জন।
রামু উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ১১ ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নে পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড় থেকে উপর্যূপোরি বৃক্ষ নিধনের কারণে অনেক আগে থেকেই এসব পাহাড় বৃক্ষশূন্য। বৃক্ষ শূণ্য এসব বিস্তৃর্ণ পাহাড়ী এলাকায় পাহাড় কেটে দরিদ্র ভূমিহীন মানুষ আশ্রয় নিয়ে বসতি গড়ে তুলে। পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা প্রশাসনের কোন নজরদারি না থাকায় কেউ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।
উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের আলিক্ষ্যামুরা, উত্তর ক্যাজর বিল, পশ্চিম ক্যাজর বিল, বেলতলী শিয়াপাড়া, জাউস পাড়া শিয়াপাড়া, পূর্ব জুমছড়ি, পশ্চিম জুমছড়ি, মন্যাকাটা, জারুলিয়াঝিরি, লোহার ঝিরি, হাজির পাড়া, খাইছাখেলা, জেরানিখোলা, ঘোনাপাড়া, হরিণ পাড়া, নারিচ বানিয়া শিয়াপাড়া, দক্ষিন থিমছড়ি, পূর্ব থিমছড়ি এলাকায় অন্তত সাড়ে চারশ পরিবার পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ফকিরনির চর, ফাঁক্রীকাটা মুরাপাড়া, কচ্ছপিয়া মুরাপাড়া, দোছড়ি দক্ষিণ কুল মুরাপাড়া, ওদাইয়াকাটা, বড় জামছড়ি নদীর পশ্চিমকুল পাহাড়পাড়া, বড় জামছড়ি নদীর পূর্ব পাহাড়পাড়া, মৌলভীকাটা নদীর পশ্চিমকুল পাহাড়পা,কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা মুরারকাচা, পশ্চিম মনিরঝিল দরগাপাড়া, পূর্ব মনিরঝিল পাহাড়পাড়া, মইশকুম ও উখিয়ারঘোনা,রশিদনগর ইউনিয়নের লম্বাঘোনা, গোলাম আলীর ঝুম, হরিতলা, পূর্ব খাদেমর পাড়া, থলিয়াঘোনা ও পাহাড়তলী, ঈদগড় ইউনিয়নের উত্তর চরপাড়া, ধুমছাকাটা, চেংছড়ি, কোনার পাড়া বুরুগ্গ্যার শিয়া, খরুলিয়ামুরা ও বৈদ্যপাড়, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের পূর্ব জোয়ারিয়ানালা মুরা পাড়া, নন্দাখালী মুরা পাড়া, উত্তর মিঠাছড়ি পাহাড়ীয়াপাড়া, পূর্ব নোনাছড়ি পাহাড়িয়া পাড়া ও ব্যাঙডেবা,রাজারকুল ইউনিয়নের ভিলিজার পাড়া, ঘোনারপাড়া, ছাগলিয়াকাটা, কাট্টলিয়া পাড়া, পশ্চিম ঘোনার পাড়া, চৌকিদার পাড়া, দক্ষিণ সিকদার পাড়া ও পাহাড়তলী, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের খরুলিয়ারছড়ি, জিনরঘোনা, পানের ছড়া পশ্চিমকুল, সমিতি পাড়া, কালা খন্দকার পাড়া, ঘোনার পাড়া ও মোরাপাড়া এবং খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দারিয়ারদীঘি, পশ্চিম দারিয়ারদীঘি, পশ্চিম দারিয়ারদীঘি, খুনিয়াপালং ও উত্তর পাড়া, পশ্চিম গোয়ালিয়াপালং, পশ্চিম ধেচুয়াপালং, পূর্ব ধেছুয়াপালং, পেঁচারদ্বীপ, হিমছড়ি, মাঙ্গালাপাড়া, দক্ষিণপাড়া, করাচিপাড়া, দরিয়ানগরসহ উপজেলার বিভিন্নস্থানে অন্তত ১০হাজার পরিবার পাহাড় চূড়ায় অথবা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার জানান, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই নদী এবং ছড়া পানিতে ভরে যায়। এসময় নদী, ছড়া থেকে বালি বা মাটি উত্তোলন সম্ভব হয়না। তাই বাধ্য হয়ে এলাকার উন্নয়ন কাজের জন্য পাহাড় থেকে বালি,মাটি সংগ্রহ করতে হয়। ফলে প্রবলধারায় বৃষ্টি হলেই ওইসব স্থানে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,গত সাত বছরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ১৫ জুনের আলোচিত হিমছড়ি সেনাবাহিনীর ১৭ ইসিবির ক্যাম্পে পাহাড় ধ্বসে মারা যান ছয় সেনা সদস্য।
সুশাসনের জন্য নাগরিক ‘সুজন’ রামুর সভাপতি মাষ্টার মোহাম্মদ আলম আমাদের রামু ডটকমকে বলেন, বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধন যারা করছে, যারা পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে বসতি স্থাপন করেছে, এদের মধ্যে অধিকাংশই মিয়ানমার নাগরিক। এরা বছরের পর বছর এদেশে অবৈধভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে,পাহাড়ে বা পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি করে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসন কিংবা বন বিভাগ এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে উপজেলার কাউয়ারখোপ, গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বন বিভাগের পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী অন্তত ২০০ বসত ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে এক পাহাড় থেকে এদের সরিয়ে দিলে অন্য পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে। লোকবলের অভাবে পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম আমাদের রামু ডটকমকে জানান, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ ও অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন করার জন্যই বর্তমানে পাহাড় গুলো মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। পাহাড় কেটে মাটি সরানো এবং ভারী বর্ষনের কারণে পাহাড়গুলো ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। আর বৃক্ষ শূন্য পাহাড়গুলোতে ঘাসের আচ্ছাদন নষ্ট করার ফলে দ্রুত ভূমি ক্ষয় হয়ে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ায়।
রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম আমাদের রামু ডটকমকে জানান,রামু উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাসরত পরিবার বা লোকের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব নেই। তবে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরানো যায় কিনা সে বিষয়ে আমরা চিন্তা ভাবনা করছি। তিনি বলেন, গাছ কেটে,পাহাড় কেটে,পাহাড় থেকে পাথর উত্তোলন করে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিনা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি।