মাস তিনেক আগেও দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সনির্বন্ধ অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘পানি’ চাওয়া হলে ‘বিদ্যুৎ’ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তার বাধাতেই প্রায় ছয় বছর হলো আলোর মুখ দেখছে না তিস্তা চুক্তি, যা বিব্রত করে চলেছে শেখ হাসিনাকে। অথচ সেই শেখ হাসিনার ‘অসম্মানে’ই নাকি মমতা বন্দোপাধ্যায় এখন বিচলিত! ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখে তিনি জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে অবমাননা করা হলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সেটা শুভ সংকেত বয়ে আনবে না!
এই চিঠির উপলক্ষ ১ জুলাইয়ের একটি ঘটনা। সেদিন কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস ভবনের সামনে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিল স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদেই সেই সমাবেশের ডাক দিয়েছিল কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনটি। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রশাসন তার অনুমতিও দিয়েছিল।
দুই সপ্তাহ আগের ওই সমাবেশে আয়োজক সংগঠনের কর্মীরা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তাদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা পোড়ান বলেও অভিযোগ ওঠে। বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষা করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে‒এই মর্মে একটি স্মারকলিপিও উপ-দূতাবাসের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
সেই ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে এখন নড়েচড়ে বসেছে মমতা বন্দোপাধ্যায় সরকার। কেন্দ্রের প্রতি মমতা দাবি জানিয়েছেন, দিল্লি-ঢাকা সুসম্পর্কের স্বার্থে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে যেন সংযত করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় নবান্ন থেকে দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে শনিবার (১৫ জুলাই) পাঠানো এক চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেদিন যেভাবে কলকাতায় বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তা ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য আদৌ কোনও ইতিবাচক বার্তা বহন করছে না। ভারত সরকার যদি সত্যিই ঢাকাকে পাশে চায়, তাহলে সঙ্ঘ পরিবার ও তার সদস্যদের এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের রাশ টানার ব্যবস্থা করুক।’
দলের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করা তৃণমূল কংগ্রেসের এক সিনিয়র সংসদ সদস্য বলেন, ‘শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে পরিষদের নেতাকর্মীরা সেদিন যেভাবে তাকে অপমান করেছেন, তৃণমূল নেত্রী তা মোটেও ভালোভাবে নেননি। একদিকে পাকিস্তান ও অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যখন চরম উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তখন দেশের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীর প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এ ধরনের আচরণ চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় বলেই আমরা মনে করছি।’
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অবশ্য মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এই অভিযোগকে মোটেও আমলে নিতে রাজি নয়। সংগঠনের সর্বভারতীয় মুখপাত্র বিনোদ বনশল বিদ্রুপের সুরে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো‒ আমরা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্দেশে চলি না। কাজেই কেন্দ্রকে চিঠি লিখে আমাদের রাশ টানতে বলার অর্থ কী, সেটা আমার বোধগম্য নয়। দ্বিতীয়ত, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতি কিসে হবে, সে ব্যাপারে অন্তত আর যারই হোক, মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে কোনও পরামর্শ শুনতে পরিষদ রাজি নয়।’
পরিষদ সূত্রে আরও দাবি করা হচ্ছে, শেখ হাসিনা অবশ্যই ভারতের বড় বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের দায়ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকেই নিতে হবে, হিন্দুদের রক্ষার ব্যবস্থাও তাকেই নিতে হবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সমাবেশ যদি সেই বাস্তবতা তাকে মনে করিয়ে দিতে চায়, তাতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে প্রভাব পড়ার কোনও কারণ নেই বলেই মনে করে পরিষদ।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় স্পষ্টতই একমত নন। বরং হাসিনার কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটাচ্ছে‒ কেন্দ্রকে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এদিন দিল্লিতে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের চিঠি নিয়ে তিনি বা তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কোনও মন্তব্য করেননি।
রিপোর্ট বাংলা ট্রিবিউনের।