একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হতে যাওয়া দেশের ছয়টি সিটি করপোরেশনে ভোট কার্যক্রমের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া দিতে চায় এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। ছয় সিটি করপোরেশনে একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের পাশাপাশি সক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষ ইসি’র। নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির প্রস্তুতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নড়েচড়ে বসেছে। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠেয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল জাতীয় নির্বাচনে বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে আগেভাগেই প্রস্তুতি শুরু করেছে দুই দল।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে ছয় সিটি করপোরেশনে ভোট কার্যক্রম একই সঙ্গে আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও সিডিউল না মেলায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ইসি দুই ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম ধাপে রংপুর সিটি করপোরেশন ও দ্বিতীয় ধাপে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ হবে।
ইসির কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘২০১৮ সালের শেষ বা ২০১৯ সালের শুরুতে যেহেতু একাদশ সংসদ নির্বাচন রয়েছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এসব সিটি করপোরেশনে ভোট কার্যক্রম সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে চায় ইসি। এজন্য আগামী বছরের মাঝামাঝির আগেই এসব নির্বাচন শেষ করতে চান তারা।’
সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই রংপুরে এবং আগামী বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই মে বা জুন মাসে বাকি পাঁচটি সিটি করপোরেশনে ভোট কার্যক্রমের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
এদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসি। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার তালিকা প্রস্তুতসহ নির্বাচনি মালামাল সংগ্রহের জন্য প্রাথমিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইসি সচিবালয় একটি সংক্ষিপ্ত কর্মপরিধিও প্রস্তুত করছে। বিশেষ করে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কাজ গুছিয়ে এনেছে ইসি। বুধবার (১৯ জুলাই) অনুষ্ঠিত কমিশন সভার এজেন্ডায় রংপুর সিটি করপোরেশনের বিষয়টি রয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা যায়।
আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপযোগী হয় মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিন আগে। জাতীয় সংসদের মতো সিটি করপোরেশনের মেয়াদ হিসাব করা হয় মেয়রের শপথগ্রহণের পর অনুষ্ঠিত প্রথম সভা থেকে। প্রথম সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর হচ্ছে প্রত্যেক সিটি করপোশেনের মেয়াদকাল।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন উপযোগী সব সিটি করপোরেশনের ভোট একই সঙ্গে করতে চেয়েছিলাম। তবে মেয়াদ কিছুটা আগে-পরে হওয়ায় একধাপে তা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো দুই ধাপে এটা সম্পন্ন করা যাবে।’
ভোটের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ইসি সচিব বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছি। বিশেষ করে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য কাজ গুছিয়ে ফেলেছি। বুধবার কমিশন সভায় এই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর আমরা নির্বাচনের সময়সীমা প্রসঙ্গে জানাতে পারবো। রংপুরের পাশাপাশি অন্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েও বুধবারের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।’
বর্তমান ইসি’র অধীনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে ইসি সচিব বলেন, ‘আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোও অবাধ, সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার মাধ্যমে নিরপেক্ষতার প্রশ্নে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে চায় ইসি। দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠেয় এসব ভোট কার্যক্রম জাতীয় নির্বাচনের ছোটখাটো মহড়ার মতো হবে।’
নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করার পর আমরা সবার প্রশংসা পেয়েছি। অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আমরা নিরপেক্ষতার প্রমাণ রেখে জনগণসহ সব রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন করতে চাই।’
ইসি’র নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও সিটি করপোরেশনের ভোট কার্যক্রমকে সামনে রেখে মাঠে নেমেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এখনও কোনও দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে না পড়লেও নির্বাচনি এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বলে জানা যায়। ইতোমধ্যে প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক বা একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী খুব একটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। তবে রাজশাহী, সিলেট ও রংপুর বাদে বাকি তিনটি সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ নতুন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারে।
ছয় সিটি করপোরেশনের ভোটের তথ্য
সিলেট: সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন। নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী বিএনপির নেতা আরিফুল হক চৌধুরী শপথ নেন একই বছরের ২১ জুলাই। এরপর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৯ সেপ্টেম্বর। তার মেয়াদ পূর্তি হবে ২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এ হিসাবে সিলেটে আগামী বছরের ১৩ মার্চ থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
রাজশাহী: রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভোট হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে হারিয়ে মেয়র হন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এরপর ২১ জুলাই শপথ নেন নতুন মেয়র। ওই বছর ৬ অক্টোবর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর। এ হিসাবে আগামী বছরের ৯ এপ্রিল থেকে ৫ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
বরিশাল: ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র শওকত হোসেন হিরণকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আহসান হাবিব কামাল। বিজয়ী মেয়র শপথ নেন ওই বছরের ২১ জুলাই। এরপর প্রথম বৈঠক হয় ২৪ অক্টোবর। তার মেয়াদ পূর্তি হবে আগামী বছরের ২৩ অক্টোবর। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত।
খুলনা: খুলনা সিটির করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে ২০১৩ সালের ১৫ জুন। বিজয়ী বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনি শপথ নেন ২১ জুলাই। এরপর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। এখানে নির্বাচন হতে হবে আগামী বছরের ৩০ মার্চ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।
রংপুর: ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ নেতা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু জয়লাভ করেন। এর পরের বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি। এরপর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ। তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ১৮ মার্চ। সে হিসাবে চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের ১৮ মার্চের মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হতে হবে।
গাজীপুর: ২০১৩ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত প্রাথী অধ্যাপক এম এ মান্নান। তিনি শপথ নেন একই বছরের ১১ আগস্ট। এখানকার প্রথম সভা হয় ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এখানে নির্বাচন দিতে হবে আগামী বছরের ৮ মার্চ থেকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।
রিপোর্ট বাংলা ট্রিবিউনের।