মুুহম্মদ নূরুল ইসলাম :
সময়টা তখন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। আমাদের দেশে আগস্টের অর্ধেক সময় বর্ষাকাল। ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। সে হিসেবে আমাদের দেশের প্রচলিত ঋতু অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এই শ্রাবণের অর্ধেক সময় আগস্ট মাস। প্রতি ইংরেজি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ ও তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতেই ভাদ্র মাস আরম্ভ। অর্থাৎ ইংরেজি মাসের ১৫ তারিখ শুরু হয় বাংলা মাস। ভাদ্র মাসকে আমাদের দেশে শীতের জন্ম মাস বলা হয়। ভাদ্র মাস থেকেই শুরু শরৎ ঋতু। ইমুদের স্কুলের পন্ডিত অবলা বাবু বয়সের কারণে স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। ফলে এখন পন্ডিত ছাড়াই চলছে স্কুল। আগস্টের শেষ সপ্তাহে স্কুলে আগমন নতুন পন্ডিতের। পন্ডিতের নাম নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি। নতুন পন্ডিত নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি স্কুলে যেদিন যোগদান করলেন সেদিনই শুরু হলো ভারী বর্ষণ। এমন ভারী বর্ষণ চোখে মেলে থাকানোর সুযোগ সেই। বর্ষণের কারণে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। টুপটাপ বৃষ্টির শব্দই শুধু শুনা যাচ্ছে। বৃষ্টিতো নয় যেনো আল্লাহ্ আকাশ থেকে পানি ঢেলে দিচ্ছেন। বৃষ্টির সাথে আবার মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। বাতাসের ঝাপটায় পথচারীদের ভিজিয়ে দিচ্ছে উম্মাতাল বৃষ্টি। বৃষ্টি হচ্ছেতো হচ্ছেই, থামার কোনো লক্ষণ নেই। টানা একদিনের বর্ষণের ফলে ঈদগাঁও নদীতে পাহাড়ি ঢল নেমেছে। সেই সুদূর মুইন পাহাড়ের চূড়া থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে আসছে। মাঝখানে ইদগড়ের জনপদকে প্লাবিত করে দিচ্ছে। কত পরিবারের আঙ্গিনার বিভিন্ন প্রকারের মালামাল ঢলের পানিতে ভাসিয়ে নিচ্ছে তার কোনো হিসেব নেই। শত কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসা পানিতে স্কুলের মাঠ, স্কুল প্রাঙ্গণ, ঘাট, সংলগ্ন এলাকা ঢলের পানিতে ডুবে একাকার হয়ে গেল। এমনকি স্কুলের নিচ তলায়ও পানি। ক্লাশ রুমে বসার সুযোগ নেই। ক্লাশের চেয়ার, লু ব্যাঞ্চ, হাই ব্যাঞ্চ সবই পানিতে ডুবে গেছে। পন্ডিত বাবুর বাসাতেও পানি। পন্ডিত বাবু স্কুলে এসে কোয়ার্টারে উঠেছেন। পাহাড়ি ঢলের পানিতে কোয়ার্টার ডুবেও ডুকে গেছে। এতে পন্ডিত বাবু রাতে ঘুমাতে পারলেন না। তিনি স্কুলের দুতলার বিজ্ঞানাগারে আশ্রয় নিলেন।
ইমুরা ছিল তখন স্কুলের সবার সিনিয়র। ইমুরা আগামী বছর এস এস সি পরীক্ষা দেবে। ৭০ সালের ব্যাচের এস এস সি পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে মার্চ মাসে। ইমুদের সিনিয়র আর কেউ নেই। স্কুলে নতুন পন্ডিত আসার পরদিন যখন পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে সব একাকার হয়ে গেল তখন স্কুলে প্রবেশ করাই মুশকিল হল। ইমুর বন্ধুদের মধ্যে ছিলো জাফর, ফরিদ, শের আলী, মৌলভী জাফর, এছারু, মকসুদ, মমতাজ, রমজান, কালাম, নজির, তোফাজ্জল, বশির, শাহ আলম, আবুল কালাম, গিয়াস, বাহাদুর, মজনু, মাহে আলম, জালাল, নূরুল আমিন, শামসুদ্দিন, মোতাহের, মীর কাসেমসহ অনেকেই। এরা সবাই ছিলো বজ্জাতের হাড্ডি। ইমুর বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন নতুন পন্ডিতের নাম দিলেন ফ্ল্যাড বাবু। একজন দুইজন করে ইমুুদের ক্লাশের সবাই নতুন পন্ডিতকে ফ্ল্যাড বাবু নামেই ডাকতে শুরু করলো। তবে সেটা প্রকাশ্যে নয়, গোপনে ও আবডালে। নামটিতে রয়েছে নতুনত্ব। নামটি সবার মনে দাগ কাটলো। এতে করে এক কান দুই কান করে স্কুলের সবার কানে পৌঁছে গেলো ফ্ল্যাড বাবু নামটি। একটি ক্লাশের জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী যখন একজন শিক্ষককে ফ্ল্যাড বাবু নামে ডাকতে শুরু করলো তখন স্কুলের তরুণ শিক্ষকেরাও নতুন পন্ডিতকে ফ্ল্যাড বাবু নামেই ডাকতে শুরু করেলো। তবে সেটা তার অনুপস্থিতিতে। নতুন পন্ডিতের নাম নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুুলি নামটি মুছে গিয়ে সেখানে ফ্ল্যাট বাবু নামটিই সবার মুখে মুখে। পুরো স্কুলে যখন ফ্ল্যাড বাবুর নাম ছড়িয়ে পড়লো তখন পন্ডিত মশাইয়ের কানেও চলে গেলো। তবে তিনি বিষয়টি কাউকে বুঝতে দিলেন না। গোপনে গোপনে তিনি চেষ্টা করলেন কিভাবে বা কারা তার নাম ফ্ল্যাড বাবু নামকরণ করেছে।
কয়েকদিন পরেই পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে গেলো। পানি নেমে যাওয়ার পরে স্কুল থেকে নোটিশ দেওয়া হলো নতুন প-িত মশাই ক্লাশ টেনের শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত হবেন। নোটিশ দেওয়ারও যৌক্তিক কারণ ছিলো। ক্লাশ টেনের ছাত্রদের সাথে পন্ডিত মশাইয়ের কোনো নির্ধারিত ক্লাশ ছিলো না। নোটিশ পাওয়ার পরে ইমুদের ক্লাশের বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের সকল ছাত্র ক্লাশে জমায়েত হলো।
সকাল সাড়ে ১০টা বাজতে তখনও কিছুক্ষণ বাকি। এরমধ্যে নতুন পন্ডিত মশাইকে সাথে নিয়ে হেড মাস্টার মশাই ক্লাশ টেনের শ্রেণী কক্ষে আসলেন। ছাত্ররা হেড মাস্টার ও পন্ডিত মশাইকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। হে মাস্টার মশাই পন্ডিত মশাইকে ছাত্রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। পন্ডিত মশাইয়ের পরনে ফিন ফিনে সাদা শান্তিপুরি ধুতি। গায়েও কদু ফুলের রঙের ফুলহাতা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিতে সোনালি রঙের বোতাম ও সংযুক্ত চেইন শোভা পাচ্ছে। ধুতির একটি কোণা পাঞ্জাবির পকেটের ভেতরে ঢুকানো। পায়ে মানানসই পলিশ করা চড়ি। পায়ের চড়ি জোড়া চক্ চক্ করছে। বেকব্রাশ করা চুল। মাথায় তেল বা ক্রিম দিয়ে এসেছেন। চুলের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ঠুটের উপর হিটলার স্টাইলের গোফ। চোখে মোটা ল্যান্সের চশমা। পন্ডিত মশাইয়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে পারফিমের গন্ধ। সবকিছু মিলে পন্ডিত মশাইয়ের ব্যক্তিত্ব বাইর থেকেই ফুটে উঠেছে। পরিপাটি, নিঁখুত গড়নের শরীর দেখে বয়স অনুমান করা যায় না। তবে দেখে মনে হলো বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।
পন্ডিত মশাই চশমার ফাঁক গলিয়ে শ্রেণি কক্ষের চারিদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। চোখের দৃষ্টি যেনো ধারালো ছুরির ফলা। সেই দৃষ্টিতে যা পড়বে সবকিছু কেটে ফালা ফালা করে ফেলবে। শ্রেণি কক্ষে পিন পতনের শব্দ নেই। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে। ভারী কণ্ঠে সবার কুশল জানতে চাইলো। পন্ডিত মশাইয়ের গলার শব্দে শ্রেণি কক্ষ গম্ গম্ করে উঠলো। সবশেষে পন্ডিত মশাই ক্লাশে উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে একটি বাক্য বয়ান করলেন।
সেই বাক্যটি হলো, “আকাশে ফেলিলে থুথু পড়ে নিজ গায়”।
ক্লাশের সবাই চুপ। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। ক্লাশে পিত পতনের শব্দও নেই। বয়ান দিয়েই পন্ডিত মশাই পায়ের চড়ির আওয়াজ তুলে শ্রেণি কক্ষ থেকে চলে গেলেন।
পন্ডিত মশাই শ্রেণি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই সবাই যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
ছাত্ররা পন্ডিত মশাইয়ের উচ্চ মার্গের সেই বয়ান বুঝতে পারলো কিনা বুঝা গেলো না। কিন্তু ইমু বুঝতে পারে নি। ইমু এস এস সি পাশ করেছে পরের বছর। এরপরে এইচ এস সি পাশ করলো, পাশ করলো স্নাতক এবং সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করলো। যতসব পাশ দিয়ে কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন করলো শুরু। ইমুর দীর্ঘ চাকুরি জীবনের একপর্যায়ে এসে বুঝতে পারলো স্কুলের নতুন পন্ডিত মশাইয়ের সেই উচ্চ মার্গের বয়ান, “আকাশে ফেলিলে থুথু পড়ে নিজ গায়”।
ইমু বুঝতে পারলো পন্ডিত নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি ধারণা করতে পেরেছিলেন ক্লাশ টেনের ছাত্ররাই তার নামকরণ করেছিলো ফ্ল্যাড বাবু। সে কারণেই তিনি ছাত্রদের একটি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেই বয়ান দিয়েছিলেন। ইমুও তার নিজের ভুল এবং তার বন্ধুদের ভুল বুঝতে পারলো। ইমু বুঝতে পারলো শিক্ষকের প্রতি ঐ আরচণ করা উচিত হয় নি। এজন্য ইমু মনে মনে লজ্জিত হলো। পন্ডিত মশাইয়ের অজ্ঞাতে সেই অপরাধের জন্য অন্তর্যামীর কাছে ক্ষমা চাইলো। ইমু আরো বুঝতে পারলো শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। শিক্ষককে গুরুজন হিসেবে মর্যাদা দেওয়া উচিত। ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। ওস্তাদ যে বয়সেরই হোন না কেনো তাঁর কদর করা উচিত।