তোফায়েল আহমদ :
নামাজে জানাজার সময় বুধবার বিকাল ৫ টা তাই আমাদের গাড়িটি যাচ্ছিল দ্রুতগতিতে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মহাসড়কের মরিচ্যা বাজার ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি পুরো ষ্টেশনটিই শূন্য। অথচ বুধবার ছিল মরিচ্যার সাপ্তাহিক বাজারের নির্ধারিত দিন। শৈশব থেকেই দেখে আসছি-পড়ন্ত বিকালের সময়টি মরিচ্যা বাজার ষ্টেশন থাকে লোকে লোকারণ্য। কিন্তু এমন বাজারের দিনেও পুরো ষ্টেশন খালি। তখনও বুঝতে পারিনি। আরো সামনে কোট বাজার ষ্টেশন। এই ষ্টেশনের অবস্থা আরো ভয়াবহ। কোথাও লোকজন নেই। এতক্ষন পর মাথায় এসেছে-এলাকার লোকজন সবাই ততক্ষনে ছুটে গেছে পালং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠে।
এই মাঠেই নামাজে জানাজা অনুষ্টিত হচ্ছে। জানাজা শুরুর খানিক আগে আমরাও হাজির হলাম মাঠটিতে। পালং হাই স্কুলের ফুটবল খেলার বিশাল মাঠ নিয়ে কত স্মৃতি এলাকাবাসীর। মাঠের দক্ষিন প্রান্তে দাঁড়িয়ে উত্তর প্রান্তে তাকিয়ে দেখলাম- যেন কুল নেই কিনারাও নেই। মানুষ আর মানুষ। সবাই কাতারে দাঁড়িয়ে কেবলামুখি। এখানেই শেষ বিদায় জানাতে ইমামের পেছনে কাতারে দাঁড়ালাম। বিউগলের করুন সুরে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা জানানো হল অন্তিম যাত্রার এই যাত্রীকে। তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদেরই ‘বাঘের বাচ্চা।’ আমার মরহুম বাবা কথায় কথায় বলতেন ‘বাঘের বাচ্চা-শমশের আলম মিয়া।’
আসলে ‘বাঘের বাচ্চা’ হিসাবে তিনি এলাকার মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশী পরিচিতি লাভ করেন আশি দশকের একটি ঘটনা নিয়ে। এসময় মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক হারে চোরাচালানের ঘটনা ঘটত। সে সময়ের সীমান্ত প্রহরী বিডিআর (বিজিবি) উখিয়ার কোটবাজার ষ্টেশনে চোরাচালান বিরোধী এক সাঁড়াশি অভিযানে নামে। এই অভিযানে বিডিআর নির্বিচারে লোকজনকে ধরে বেধড়ক পিটাতে থাকে। নির্বিচারের অভিযানে নিরীহ অনেকের দোকান-পাঠও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় শমশের আলম চৌধুরী নির্যাতিত জনগনকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুললেন। শেষ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার জন্য কোটবাজার ষ্টেশনে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হল তাদের। জনতার আন্দোলনের বিজয় হল। আর এই বিজয়ের নায়ক হলেন-‘বাঘের বাচ্চা শমশের আলম চৌধুরী।’
বাস্তবে দক্ষিন জনপদের মানুষের কাছে মরহুম আলহাজ্ব শমশের আলম চৌধুরীর একটিই পরিচয় ছিল তিনি ‘বাঘের বাচ্চা।’ অসীম সাহসি লোক ছিলেন। কাউকেই পরোয়া করতেন না। প্রভাবশালী আর ক্ষমতাশালী যত বড়ই হোক না কেন সত্য উচ্চারণই করে যেতেন। আজীবন লড়েছেন তিনি ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। একজন সৎ ও ন্যায়ের প্রতীক বলতে একজন লোকই সবার নিকট পরীক্ষিত হয়ে চির বিদায় নিলেন-তিনি মরহুম আলহাজ্ব শমশের আলম চৌধুরী। জীবনে তিনি বহুবার নির্বাচন করেছেন। এসব নির্বাচনে যেমনি সত্য উচ্চারণের জন্য তিনি জিতেছেন তেমনি পরাজিতও হয়েছেন মিথ্যার পক্ষে সায় না দেয়ার জন্য। কিন্তু পেছনে পা দেননি। জনসেবার পথ থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সরে পড়েননি। আমৃত্যু একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শেই উজ্জিবীত ছিলেন তিনি। শত প্রলোভনেও দল বদল করেননি। সরে যাননি নৌকা মার্কার প্রতীক সমর্থন থেকেও।
অকুতোভয় একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মরহুম আলহাজ্ব শমশের আলম চৌধুরী। দেশ মাতৃকার জন্য কিনা করেছেন তিনি। টগবগে রক্তের এই মানুষটি পশ্চিমা হানাদারদের কথা বলতেই যেন শূন্যে লাফিয়ে উঠতেন। দেশ স্বাধীন হবার মুহুর্তে কক্সবাজারকে শত্রুমুক্ত করার অভিযানে বেশ ক’জন পাঞ্জাবী সৈন্য ধরে নিয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ের পানেরছড়া ঢালায় খতম করে দিয়েছিলেন এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। অসাধারণ একজন দেশপ্রেমিক লোক ছিলেন মরহুম চৌধুরী। হাজারো আর লাখো কোটি টাকার প্রলোভনে বিন্দু মাত্র নড়াচড়া করার লোক অন্তত তিনি ছিলেন না। এ জনপদে এমন একজন শমশের আলম চৌধুরীর জন্ম হবে ? আমরা কি পাব এরকম একজন শমশের আলম চৌধুরীর মত নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত মানুষ ? মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট ফরিয়াদ জানাই-হে আল্লাহ এমন মানুষটিকে বেহেশত নসীব করুন। ## তোফায়েল আহমদ, বিশিস্ট সাংবাদিক ও দৈনিক কালের কন্ঠের জেষ্ঠ প্রতিবেদক।
[email protected]