সমকালঃ
শুধু আইনের প্রয়োগ করে শিশু নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি পরিপত্র জারি করে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার সমকাল ও ওয়ার্ল্ডভিশন আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা’ শীর্ষক ওই বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। সমকালের উপ-সম্পাদক অজয় দাশগুপ্তের সঞ্চালনায় বৈঠকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য দেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইকরামুল হক, ইউএনডিপি ডেমোক্রেটিক গভর্ন্যান্স ক্লাস্টারের পলিসি স্পেশালিস্ট মোজাম্মেল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম রাব্বানী, ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোহসীন আলী, ব্রেকিং দি সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা, ওয়ার্ল্ডভিশনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর চন্দন জেড গোমেজ এবং ডেপুটি ডিরেক্টর (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড জাস্টিজ ফর চিলড্রেন) সাবিরা নুর, এডুকে-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর জনি সরকার, ফ্রেন্ডশিপের পরিচালক (শিক্ষা ও সুশাসন) আয়েশা তাহসিন খান, ময়মনসিংহ সদরের ১৩নং বয়ড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, নান্দাইল থানার ৯নং আচারগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম মোফাজ্জল হোসেন কাইয়ুম এবং বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হোসনেয়ারা মিলী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, বর্তমান সরকার নারী ও শিশুবান্ধব। এমন সরকারের আমলে শিশু নির্যাতন বন্ধ না করতে পারাটা দুর্ভাগ্যজনক। সুবিধাবঞ্চিত শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে সবাইকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। শিশু নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা জরুরি মন্তব্য করে রিয়াজুল হক বলেন, এ ক্ষেত্রে একটি কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাবনা তৈরি করে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা যেতে পারে।
ইকরামুল হক বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে শিশু নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। এজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব অনেক বেশি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিশু নির্যাতন বন্ধে গ্রাম আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদ যেন কার্যকর ভূমিকা নেয়, সেজন্য প্রয়োজনে পরিপত্র জারি করা যেতে পারে।
অজয় দাশগুপ্ত বলেন, শিশু নির্যাতন বন্ধ করতে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, ব্যক্তিগত পর্যায়েও উদ্যোগী হতে হবে। শিশুর জন্য কল্যাণমূলক কাজ করতে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ তহবিল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। শিশু নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের উন্নয়নে কাজ করা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সংশ্নিষ্টদের দায়িত্ব।
গোলাম রাব্বানী বলেন, শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার কাজে সবসময় টাকার প্রয়োজন হয় না। এজন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
মোহসীন আলী বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে একটি সার্কুলার জারি করে শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারে।
উন্নয়ন প্রকল্পে নারীর সঙ্গে শিশুকে জুড়ে দেওয়া হয় বলে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন রোকসানা সুলতানা। তিনি বলেন, শিশুর উন্নয়ন ও নির্যাতন বন্ধে অনেক ভালো আইন থাকলেও কার্যত এর প্রয়োগ নেই।
সাবেরা নূপুর বলেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের কারিকুলামে ‘শিশু অধিকার ও সুরক্ষা’ বিষয়ে একটি অধিবেশন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক প্রতিবেদনে শিশুবিষয়ক বাধ্যতামূলক একটি অংশ রাখা নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ফল পাওয়া যেতে পারে।
জনি সরকার বলেন, গ্রামপর্যায়ে শিশুর শারীরিক-যৌন নির্যাতনসহ সব নির্যাতন বন্ধে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে বছরে দু’বার ওয়ার্ড সভা হয়। ওই সভায় শিশু নির্যাতনবিরোধী অঙ্গীকার করানো হলে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে।
হোসনেয়ারা মিলী বলেন, যৌথভাবে নারী ও শিশুর জন্য নানামুখী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হলেও শুধু শিশুদের জন্য উদ্যোগ কম। বিশেষ করে দরিদ্র শিশুর ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নেই। তাই মা-বাবাহীন শিশুদের স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা কম। তাদের স্কুলে পাঠাতে সরকার ভাতা দেওয়ার মতো বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে।
আব্দুর রহমান জানান, তার এলাকায় সচেতনভাবে শিশুর জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় এবং তাদের উন্নয়নে কাজ করা হয়।
মোফাজ্জল হোসেন বলেন, সরকার প্রত্যন্ত অবহেলিত অঞ্চলের শিশুদের জন্য আলাদা ভাতার ব্যবস্থা করলে সহজেই তাদের স্কুলমুখী করা সম্ভব।
আয়েশা তাহসিন খান বলেন, পরিবারবিচ্ছিন্ন শিশুদের ভাতা দিতে হবে। স্থানীয় সরকারের শিশুবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
বৈঠকের শুরুতে ‘শিশুর প্রতি শারীরিক সহিংসতা বন্ধ হোক’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করে চন্দন জেড গোমেজ বলেন, দেশে ১৪ বছরের কম বয়সী প্রায় ৮২ শতাংশ শিশু নানাভাবে সহিংতার শিকার হচ্ছে। ৭৭ দশমিক এক শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার হয় বিদ্যালয়ে। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয় ৫৭ শতাংশ শিশু। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২১৬ শিশু। এর মধ্যে বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়েছে ৩২ জন এবং শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছে ৯২ জন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতনে আহত হয়েছে ৬৯ শিশু।