গৌরবোজ্জ্বল ও প্রশংসনীয় অবদানের জন্য একুশের প্রদকের জন্য চুড়ান্তভাবে মনোনীত ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের কৃতি সন্তান রাখাইন সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র মংছেনচীং মংছিন। ১০ ফেব্রুয়ারী তারিখ বুধবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৬ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারী ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে পদক দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কক্সবাজার সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ক্যথিংঅং এর আপন চাচা এবং সাবেক সংসদ সদস্য
অধ্যাপিকা এথিন রাখাইনের চাচা শশুড় মংছিনের জন্ম কক্সবাজার শহরের চাউল বাজার সড়কস্থ পিত্রালয়ে ১৯৬১ খ্রি. সনে ১৬ জুলাই রোজ শুক্রবারে। তিনি প্রয়াত অং চা থোয়েন ও প্রয়াত মাক্যচীং দম্পতির ৫ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে সবার কনিষ্ঠ। তিনি শৈশব থেকে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় রাখাইন জাতির ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে লেখালেখি করে চলেছেন।
বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কথিকা লেখক ও পাঠক। তিনি রাখাইন নৃত্য, চারু ও কারুকলা এবং বাংলা, ইংরেজি, পালি, রাখাইন, মারমা, বার্মিজ, ত্রিপুরা ও চাক্মা ভাষায় পড়া ও লেখার পারদর্শী। বাংলাদেশ রাখাইন বৌদ্ধ সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সাথে ঔতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ফোকলোর (গ্রামীণ লোক সাহিত্য) সোসাইটি, টাঙ্গাইল ছায়ানীড় ও বিশ্ব বাংলা সাহিত্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী পরিষদ- এর সদস্য।
কক্সবাজার কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি ছিলেন ইউ,ও,টি,সি (U.O.T.C) ডিটাসমেন্টের একজন ক্যাডেট। পেশায় তিনি সাংবাদিক ও গবেষক; পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে উচ্চকণ্ঠ। তিনি অনেক পদক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ছাত্র জীবনে তিনি সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অসংখ্য পুরস্কার প্রাপ্ত। প্রাপ্ত পুরস্কার ও সনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা, রাখাইন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিশেষ অবদানে স্বীকৃতি স্বরূপ, আলোক নব গ্রহ ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটি, খাগড়াছড়ি সদর, খাগড়াছড়ি হইতে শুভ – বুদ্ধ পূর্ণিমা’ দিবসে “সম্মাননা সনদ” ২০১৩খ্রি.। টাঙ্গাইলে ছায়ানীড় ভাষা গবেষণা বিভাগ আয়োজিত সর্বস্তরে বাংলা ভাষা; শুদ্ধ বানানে শুদ্ধ উচ্চারণে ‘উপজেলা কর্মশালার’ ‘সম্মাননা সনদ’২০১৩খ্রি. (তারিখ ২০ জুন ২০১৩খ্রি.)। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত সুন্দরবন আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখায় “সম্মাননা সনদ” কবিতীর্থ। জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ২০১৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত ছায়ানীড়ের ২৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে. ‘ছায়ানীড় স্মারক সম্মাননা’। পশ্চীম বঙ্গে কলিকাতায় নন্দন চত্ত্বরের মুর্শিদাবাদ রাহিলা সংস্কৃতি সংঘ-এর ৩০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে, ২১ ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে এবং বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষিতে সাহিত্য সংস্কৃতি উৎসব-এর ‘রাহিলা সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫’ এবং ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারী তারিখে খুলনায় ‘প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্য ফুলকলি পুরস্কার-২০১৬খ্রি., ইত্যাদি।
তিনি ১৯৮৭ খ্রি. সাল হতে ১৯৯৪ খ্রি. সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের পপুলেশন কনসার্ণ পরিচালিত রাখাইন সমম্বিত পরিবার কল্যাণ প্রকল্পের কক্সবাজার ও বান্দরবান পার্বত্যজেলা ‘প্রকল্প পরিদর্শক’ পদে চাকুরিরত ছিলেন।
বর্তমানে তিনি ‘রাখাইন’ সাময়িকীর সম্পাদক, বৃহত্তর পার্বত্য অঞ্চলের (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) সর্বপ্রথম ও চট্টগ্রাম বিভাগের সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বনভূমি ও দৈনিক গিরি দর্পণ পত্রিকায় বিশেষ প্রতিনিধি (সমগ্র বাংলাদেশ) হিসেবে কর্মরত।
তাঁর উএনু(প্রিয়াংকা/পুতুল) ও চেনচেননু তুলি নামে দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। পিতার ন্যায় মেয়ে দুটিও বিরল প্রতিভার অধিকারী। বড় মেয়ে উএনু (প্রিয়াংকা পুতুল) ২০০১ সালে জাতীয় শিশু সম্পাহ উপলক্ষে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় ‘স্বর্ণ পদক’ বিজয়ীনি। বর্তমানে সে দুই কন্যা সন্তানের জননী (প্রমিথি ও পরিধি) এবং মহালছড়ি চৌংড়াছড়ি মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে কর্মরত। ছোট মেয়ে চেনচেননুও জাতীয় রচনা প্রতিয়োগিতায় ‘রৌপ্য পদক’সহ ২০১১ সালের জাতীয় বির্তক প্রতিযোগিতায় “শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক” হিসেবে নির্বাচিত। বর্তমানে সে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী মি. মংছেনচীং(মংছিন্) এর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বাংলাদেশ রাখাইন জাতির সর্ব প্রথম ও একমাত্র গবেষণা মূলক গ্রন্থ ‘রাখাইন ইতিবৃত্ত’ সুধী পাঠক সমাজে যথেষ্ট সমাদূত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের রাখাইন পরিচিতি, রাখাইন ইতিবৃত্ত, সৈকত নন্দিনী (কবিতা), রাখাইন-বাংলা কথোপকথন (ভাষা শিখুন, প্রথম পাঠ), অগ্গমেধা বৌদ্ধ মন্দির এবং উ কোঁসাল্লা মহাথেরো, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ শুভ-অশুভ দিন পঞ্জিকা (রাখাইন ভাষায়), রাখাইনালোক (ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়), রাখাইন জাতির রত্ন, রাখাইনাদর্শ, রাখাইন- বাংলা কথোপকথন, ভাষা শিখুন, রাখাইন-ত্রিপুরা জাতিসত্তা, আলোক নবগ্রহ ও চন্দ্রমণি মহাথেরো, রাখাইন আলাং (আলোকিত রাখাইন, রাখাইন ভাষা), রাখাইন চাগা (রাখাইন ভাষা), রাখাইন চাথ্রান (রাখাইন গান, রাখাইন ভাষা) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, এছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যাও রয়েছে ১২টি। তাঁর সহধর্মিণী শোভা রাণী ত্রিপুরা পেশায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ও সু-প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি।
তাঁদের অনেক পান্ডুলিপি এখনো প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। বিরল প্রতিভা ও বহুমুখী মেধা সম্পন্ন ক্ষণজন্মা মংছেনচীং মংছিন এর গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ কর্মকে জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি স্বরূপ অত্যন্ত সম্মানজনক একুশের পদকের জন্য মনোনীত করা হল।