ক্রীড়া ডেস্কঃ
ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ডেলিভারিটি হতেই দুহাত ওপরে তুলে ছুটলেন মুস্তাফিজুর রহমানের দিকে। মুশফিকুর রহিম ছুটলেন দিগ্বিদিক। ব্যাটসম্যান সামিউল্লাহ শেনওয়ারির হাত থেকে ছুটে ব্যাট উড়ছে তখন বাতাসে। উড়ছেন তখন বাংলাদেশের ফিল্ডাররাও। শেষ ওভার আর শেষ বলে হারের বেদনায় পুড়তে হয়েছে অনেকবার; এবার রচিত হলো বিজয়ের গল্প। হারের মুখ থেকে বাংলাদেশের জয়!
শেষ ওভারে আফগানিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৮ রান। হাতে ৪ উইকেট। উইকেটে আক্রমণাত্মক দুই ব্যাটসম্যান। কিন্তু অসাধারণ শেষ ওভারে দলকে রোমাঞ্চকর জয় উপহার দিলেন মুস্তাফিজ। আফগানিস্তানকে ৩ রানে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালের সম্ভাবনা ভালোভাবেই টিকিয়ে রাখল বাংলাদেশ। ছিটকে গেল আফগানরা।
আবু ধাবিতে রোববার শুরুতে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশকে ২৪৯ রানের স্কোর এনে দেয় মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুল কায়েসের দুর্দান্ত দুটি ইনিংস। রান তাড়ায় এক পর্যায়ে আফগানরা ছিল জয়ের কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে যায় ২৪৬ রানে।
শেষ ওভারে স্ট্রাইকে ছিলেন রশিদ খান, যিনি আগের ম্যাচেই বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে উড়িয়েছিলেন বাংলাদেশকে। অন্য প্রান্তে শেনওয়ারি, খেলছিলেন দুর্দান্ত। মুস্তাফিজকে মনে হচ্ছিল গরমে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। কিন্তু শেষ ওভারে বাঁহাতি পেসার অন্য চেহারায়।
প্রথম বলে দুই রান নিয়েছিলেন রশিদ। পরের বলে ফিরতি ক্যাচে আউট। তৃতীয় বলে লেগ বাই। পরের বলে রান নিতে পারলেন না নতুন ব্যাটসম্যান গুলবদিন নাইব। পঞ্চম বলে লেগ বাই থেকে এক রান। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল চার। অফ স্টাম্পের বাইরে শট বলটায় পুল করতে গিয়ে ব্যাটই হাতে রাখতে পারলেন না শেনওয়ারি। বল মুশফিকের গ্লাভসে। বাংলাদেশের রুদ্ধশ্বাস জয়।
শেষের মতো ছিল বাংলাদেশের শুরুটাও। এক পর্যায়ে দল ছিল খাদের কিনারা। দারুণ শুরু করা লিটন দাস আউট হয়েছিলেন অবিশ্বাস্য বাজে এক শটে। দুই ভরসা সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম পরপর রান আউট দলকে হতাশায় ডুবিয়ে। ৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে দিশাহারা দল। সেখান থেকে উদ্ধার ইমরুল ও মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে।
আগের রাতে ঢাকা থেকে উড়ে যখন টিম হোটেল আসেন ইমরুল, দুবাইয়ে তখন পেরিয়ে গেছে তখন প্রায় মাঝরাত। সকালে আবার বাস ভ্রমণে আবু ধাবি। একাদশে জায়গা পেলেন, তবে ওপেনিংয়ে নয়। যে কারণেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হোক, কাজে লাগে দারুণভাবে।
বিপর্যয়ে দাঁড়িয়েই ইমরুল ও মাহমুদউল্লাহ গড়েন ১২৮ রানের জুটি যা ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের রেকর্ড। ভেঙেছেন প্রায় ১৯ বছর আগের রেকর্ড। ১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঢাকায় ১২৩ রানের জুটি গড়েছিলেন আল শাহরিয়ার ও খালেদ মাসুদ।
এই জুটির আগে বাংলাদেশের ইনিংস ছিল টালমাটাল। লিটন ও নাজমুল হোসেন শান্তর উদ্বোধনী জুটি সুযোগ পায় আরও একটি ম্যাচ। সেটিও হেলায় হারান শান্ত। আফতাব আলমকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বিলিয়ে আসেন উইকেট। তিনে প্রমোশন পাওয়া মোহাম্মদ মিঠুন এলবিডব্লিউ মুজিব উর রহমানের দারুণ টার্নিং বলে।
১৮ রানে ২ উইকেট হারানোর ধাক্কা অনেকটাই সামাল দিয়েছিলেন লিটন ও মুশফিক। আগের তিন ম্যাচে হতাশ করা লিটন এ দিন শুরু থেকেই খেলছিলেন আস্থায়। ৯ রানে জীবন পেয়ে মুশফিকও উইকেটে জমে গিয়েছিলেন।
জুটিতে যখন বাড়ছে সম্ভাবনা, পথ হারানোর শুরু তখনই। রশিদ খানের প্রথম ওভারেই দৃষ্টিনন্দন ইনসাইড আউট শটে চার মারলেন লিটন। সম্ভবত গোটা টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা শট। এরপরই যেন হারিয়ে ফেললেন নিজেকে। পরের বলেই স্লগ করতে গেলেন, বল উঠল আকাশে। ৪৩ বলে ৪১ রানের সম্ভাবনাময় ইনিংসটির অপমৃত্যু। ভাঙল ৬৩ রানের জুটি।
সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই আরও দুটি প্রবল আঘাত। লিটনের বিদায়ের এক বল পরই সাকিবের রান আউটটি ছিল স্রেফ আত্মহনন। এক ওভার পরে ইমরুলের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট ৩৩ রান করা মুশফিক। হঠাৎই এলোমেলো বাংলাদেশ।
ইমরুল ও মাহমুদউল্লাহর লড়াই শুরু এরপরই। ইমরুল সময় নিয়ে থিতু হয়েছেন। মাহমুদউল্লাহ শুরু থেকেই ছিলেন সাবলীল। মূল দুই হুমকি মুজিব ও রশিদকে দুজনই সামলেছেন দারুণ। চাপের সময় এই স্পিনারদের আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেওয়াটাও পক্ষে এসেছে বাংলাদেশের। ওই দুজন সেটি কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে।
রশিদ যখন পরে আক্রমণে এসেছেন, ততক্ষণে দুজনই খেলছিলেন দুর্দান্ত। ২১তম ওভারে বাঁধা জুটি আলাদা হয়েছে ৪৭তম ওভারে। উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফিরেছেন মাহমুদউল্লাহ। ৮১ বলে ৭৪ রানের ইনিংসটায় তিনটি চারের পাশে দুটি ছক্কা মেরেছেন রশিদ খানকে।
শেষ দিকে মাশরাফি-মিরাজ খুব গতি আনতে পারেননি ইনিংসে। তবে ইমরুল ছিলেন, ইনিংস শেষ করেছেন বাউন্ডারিতে। তিন নম্বরের নিচে প্রথমবার ব্যাট করতে নেমে ৮৭ বলে অপরাজিত ৭২। দল তাতে পেয়ে গেছে লড়াইয়ের রান।
ব্যাটিংয়ে ভালো শেষের পর বোলিংয়ের শুরুটায় চাওয়ার সঙ্গে মিলেছিল পাওয়া। মাশরাফি নতুন বলে সুবিধা করতে পারেননি। তবে পঞ্চম ওভারে বোলিংয়ে এসে মুস্তাফিজ প্রথম বলেই এনে দেন উইকেট। তিনে নামা রহমত শাহকে ফেরায় সাকিবের চোখধাঁধানো ফিল্ডিং আর বুলেট গতির সরাসরি থ্রো।
জোড়া উইকেটের আগে অবশ্য ছিল হতাশা। অভিষিক্ত নাজমুল অপুর বলে ৯ রানে শাহজাদের ক্যাচ ছাড়েন মিঠুন। সেই হতাশা পরে আরও পুড়িয়েছে শাহজাদ ইনিংসটা টেনে নেওয়ায়। শুধু ফিফটিই করেননি, হাশমতউল্লাহ শাহিদির সঙ্গে গড়েছেন তৃতীয় উইকেটে ৬৩ রানের জুটি।
এমনিতে আক্রমণাত্মক হলেও শাহজাদ এ দিন ছিলেন একটু মন্থর। ৭৩ বলে করেন ফিফটি। তার ব্যাটে যখন রান বাড়ানোর তাড়া, দারুণ এক ডেলিভারিতে জুটি ভাঙেন মাহমুদউল্লাহ। নিজের প্রথম ওভারেই বুদ্ধিদীপ্ত ডেলিভারিতে বোল্ড করেন ৫৩ রান করা শাহজাদকে।
তবে জুটি ভাঙার পর আফগানদের চাপে ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ। আসগর আফগান ও হাশমতউল্লাহ শাহিদির ৭৮ রানের জুটি এগিয়ে নেয় তাদের।
গরমে প্রচণ্ড ধুঁকছিলেন মাশরাফি। তবে তার হাত ধরেই ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ। ৩৯ রান করা আসগার ও ৭১ রান করা শাহিদিকে ফেরান নিজের তিন ওভারের মধ্যে। পূর্ণ করেন আড়াইশ ওয়ানডে উইকেট।
আফগানরা হাল ছাড়েনি। মোহাম্মদ নবি ও শেনওয়ারি তুলেছেন ঝড়। শেষের আগের ওভারে সাকিবকে যখন ছক্কায় ওড়ালেন নবি, ১০ বলে তখন প্রয়োজন ১২ রান। আশার প্রায় সমাধি।
পরের বলেই সাকিবের ফুল টসে সীমানায় ক্যাচ দিলেন নবি। আশা এরপরও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু পায়ে ক্র্যাম্প নিয়েও শেষ ওভারে নিজেকে উজার করে দিলেন মুস্তাফিজ। শেষ বলের ফয়সালাও জেতাও যায়, বাংলাদেশ পেল সেই বিরল ও অনির্বচনীয় স্বাদ!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৪৯/৭ (লিটন ৪১, শান্ত ৬, মিঠুন ১, মুশফিক ৩৩, সাকিব ০, ইমরুল ৭২*, মাহমুদউল্লাহ ৭৪*, মাশরাফি ১০, মিরাজ ৫*; আফতাব ৩/৫৪, মুজিব ১/৩৫, গুলবদিন ০/৫৮, নবি ০/৪৪, রশিদ ১/৪৬, শেনওয়ারি ০/৯)।
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৪৬/৭(শাহজাদ ৫৩, ইহসানউল্লাহ ৮, রহমত ১, হাসমতউল্লাহ ৭১, আসগর ৩৯, নবি ৩৮, শেনওয়ারি ২৩*, রশিদ ৫ গুলবদিন ৫*; মাশরাফি ২/৬২, অপু ০/২৯, মুস্তাফিজ ২/৪৪, মিরাজ ০/৩৬, সাকিব ১/৫৫, মাহমুদউল্লাহ ১/১৭)।
ফল: বাংলাদেশ ৩ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মাহমুদউল্লাহ
সূত্রঃ বিডিনিউজ