ক্রীড়া ডেস্কঃ
আরেকটি ফাইনাল, আবারও শেষ ওভার। সেই শেষ বল। একই তেতো স্বাদ। মিরপুর থেকে বেঙ্গালুরু। কলম্বো থেকে এবার দুবাই। ফাইনাল হয়ে রইল বাংলাদেশের হৃদয় ভাঙার দুঃখগাঁথা। স্বল্প পুঁজি নিয়েও বীরোচিত লড়াই হলো। দোলা দিল রোমাঞ্চ, জাগাল আশা। কিন্তু শেষ বেলায় হারিয়ে গেল সব। আবারও খুব কাছে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়ল বাংলাদেশ।
রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার এশিয়া কাপ ফাইনালে শেষ বলে হারল বাংলাদেশ। দুবাইয়ে শেষ বলের ফয়সালায় শেষ হাসি ভারতের। তিন উইকেটের জয়ে এশিয়ার সফলতম দলটি আরও সমৃদ্ধ করল নিজেদের রেকর্ড।
এই নিয়ে সপ্তমবার এশিয়া কাপ জিতল ভারত। সবশেষ চারবারের তিনটিই ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ হারল সবকটিই।
দুবাইয়ে শুক্রবার লিটন দাসের ১২১ রানের অসাধারণ ইনিংসের পরও বাংলাদেশ গুটিয়ে গিয়েছিল ২২২ রানে। এই রান নিয়েও ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে নাড়া দেওয়া গেল। কিন্তু আটকে রাখা গেল না। শেষ বলে জিতে গেল ভারত।
শেষ তিন ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল কেবল ১৩ রান, হাতে ৫ উইকেট। দারুণ দুটি ওভারে সেই ম্যাচও জমিয়ে দিলেন রুবেল হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান। রুবেল ফেরালেন রবীন্দ্র জাদেজাকে, পরের ওভারে মুস্তাফিজের শিকার ভুবনেশ্বর কুমার। শেষ ওভারের সমীকরণ ৬ রান।
মিরাজ এ দিন ভালো বোলিং করতে পারেননি। তাই শেষ ওভারের ভার পড়েছিল মাহমুদউল্লাহর ওপর। চেষ্টার কমতি রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন শেষ বল পর্যন্ত। লেগ স্টাম্পে থাকা বলে লেগ বাই রানে জিতে গেল ভারত।
হতাশায় শেষ হওয়া ম্যাচে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। ওপেনিংয়ে টানা ব্যর্থতায় বিরক্ত অধিনায়ক এদিন লিটন দাসের সঙ্গে ইনিংস শুরু করতে পাঠান মিরাজকে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথমবার পাঁচের ওপরে ব্যাট করতে নামা মিরাজ আর ১৭ ওয়ানডে খেলেও ফিফটি না পাওয়া লিটন উপহার দেন বড় বিস্ময়।
দুজন মিলে দলকে এনে দিলেন ১২০ রানের ভিত। ভারতের বিপক্ষে যেটি বাংলাদেশের রেকর্ড শুরু। পেছনে পড়ে ২০১৫ সালে মিরপুরে তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের ১০২ রানের জুটি।
কিন্তু এই জুটি হারানোর পরই বাংলাদেশের পথ হারানোর শুরু। পরের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সৌম্য সরকার ছাড়া দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি আর কেউ।
আগের ৫ ম্যাচে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি ছিল ১৬ রানের। হারানোর আর কিছু নাই ধরে নিয়েই মিরাজকে নামানো হয় ওপেনিংয়ে। দায়িত্ব ছিল তার একপাশ আগলে রাখা। সেই দায়িত্ব পালন করেছেন দারুণভাবে। আরেক পাশে লিটন মেলে ধরেছিলেন মুগ্ধতা জাগানিয়া শটের পসরা।
শুরুতেই অবশ্য আউট হতে পারতেন লিটন। তার ১ রানে দ্বিতীয় স্লিপে ডানে ঝাঁপিয়েও ক্যাচ নিতে পারেননি দিনেশ কার্তিক। সেই মুহূর্ত লিটন ভুলিয়ে দেন দ্রুতই। দারুণ সব শটে বাড়াতে থাকেন রান। পেস সরিয়ে স্পিন এনেও থামানো যায়নি তাকে। লেগ স্পিনার যুজবেন্দ চেহেলের দ্বিতীয় ওভারে ছক্কা মারেন দুটি।
বড় ভুল করে বসেছিলেন লিটন এমন শুরুর পরও। রবীন্দ্র জাদেজাকে দারুণ এক বাউন্ডারিতে ৩৩ বলে স্পর্শ করেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি। এক বল পরই আত্মঘাতী শটে তুলে দিলেন ক্যাচ। কিন্তু বৃত্তের ভেতরই ক্যাচটি নিতে পারলেন না চেহেল। এরপর আর একবারও ভুলের পথে পা বাড়াননি লিটন।
জমে ওঠা এই জুটিকে শেষ পর্যন্ত থামান ভারতের জুটি ভাঙার বিশেষজ্ঞ কেদার যাদব। ৫৯ বলে ৩২ রান করা মিরাজ ক্যাচ তুলে দেন পয়েন্টে।
বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার শুরু সেখান থেকেই। তিনে নামা ইমরুল কায়েস টানা দ্বিতীয় ম্যাচে এলবিডব্লিউ লেগ স্পিনে। আগের ম্যাচে শাদাব খানের পর এবার চেহেলের শিকার। সবচেয়ে বড় ধাক্কা এরপরই। কেদারের নিরীহ এক বলে আউট টুর্নামেন্টে দলের সেরা ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম।
গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনালে এভাবেই মাঝপথে তামিম ও মুশফিকের উইকেট নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন কেদার। সেবার ফুল টসে ফিরেছিলেন মুশফিক। এবার অফ স্টাম্পের বাইরের মন্থর ও নিচু বাউন্সের বল পুল করে ধরা মিড উইকেটে।
সেই ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই দৃষ্টিকটুভাবে রান আউট মোহাম্মদ মিঠুন। লিটনের ৮৫ রানেও দল ছিল উইকেটবিহীন, ৯৫ পর্যন্ত যেতে যেতেই আরেকপাশে হারালেন চার সঙ্গীকে।
বিপর্যয়ে অনেকবার ত্রাতা হয়েছেন যিনি, সেই মাহমুদউল্লাহও এদিন হতাশার প্রতিশব্দ। অযথা স্লগ করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে এলেন কুলদীপকে। দারুণ শুরুর পরও ৩১ রানের মধ্যে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে তখন ৫ উইকেট।
লিটনের ব্যাটিংয়ে সেসবের প্রভাব পড়েনি একটুও। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ৮৭ বলে। সাতে নামা সৌম্য সরকারকে নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছিলেন দলকে। তখনও আশা ছিল দলের আড়াইশ পেরিয়ে যাওয়ার।
তৃতীয় আম্পায়ার প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তে থামতে হলো লিটনকেও। কুলদীপের বলে স্টাম্পিংয়ের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিলেন রড টাকার, অনেকবার দেখলেন রিপ্লে। তার পর পর্দায় ফুটিয়ে দিলেন ১১৭ বলে ১২১ রান করা লিটনের বিদায়ের দণ্ড। ‘বেনিফিট অব ডাউট’ সবসময় ব্যাটসম্যানের পক্ষে যাওয়াই নিয়ম, সেটি লিটন পেলেন কিনা, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে।
লিটনের ১২ চার ও ২ ছক্কায় ইনিংসটায় অবশ্য নিজেকে নতুন করে চিনিয়ে গেলেন লিটন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাথেয়ও হতে পারে এই ইনিংস।
তবে দল ততক্ষণে পথ হারিয়েছে পুরোপুরি। কুলদীপের বলেই বিশাল ছক্কা মারার পর স্টাম্পড মাশরাফি। শেষ দিকে কিছু রান বাড়ানোর আশা হয়ে টিকেছিলেন সৌম্য। ৩৩ রান করে তিনিও ফিরলেন রান আউটে। পরের বলেই বুমরাহর ইয়র্কারে রুবেলের বিদায়ে ইনিংসের যবানিকা।
প্রথম ইনিংস শেষে ম্যাচ অনেকটাই হেলে ভারতের দিকে। ব্যাটিং উইকেটে এই রানে ভারতকে আটকে রাখা ছিল দুঃসাধ্য। কিন্তু বাংলাদেশের উজ্জীবিত বোলিং-ফিল্ডিং ম্যাচে ফেরায় প্রাণ।
সবচেয়ে বড় ভয় ছিল ভারতের উদ্বোধনী জুটি নিয়ে। শিখর ধাওয়ান ও রোহিত শর্মার একজন দাঁড়িয়ে গেলেও এই রান হয়ে যাবে মামুলি।
ঝড়ের ইঙ্গিতও ছিল শুরুতে। তবে সেই ঝাপটা দীর্ঘায়িত হতে দেননি নাজমুল ইসলাম অপু। প্রথম ওভারে ছক্কা-চার হজম করেছেন। তবে ধাওয়ানের উইকেটও এনে দিয়েছেন। এমনিতে বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার হলেও কবজির মোচড়ে বল ছেড়ে আউট করেছেন ধাওয়ানকে। টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো পঞ্চাশের আগে ভেঙেছে ভারতের উদ্বোধনী জুটি।
অষ্টম ওভারে বোলিংয়ে এসে মাশরাফি তৃতীয় বলেই ফিরিয়েছেন আম্বাতি রায়ডুকে।
রোহিত দারুণ খেলছিলেন। হুমকিও ছড়াচ্ছিলেন। ৩টি ছক্কা মেরেছেন। থিতু হওয়ার পর তাকে আউট করা ওয়ানডেতে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। কিন্তু সেটিই করে দেখালেন রুবেল।
শুরু থেকেই আঁটসাঁট বোলিংয়ে রোহিতকে আটকে রেখেছিলেন রুবেল। প্রিয় পুল শটে চাপটা সরাতে গিয়ে রোহিত ৪৮ রানে ক্যাচ দিয়েছেন স্কয়ার লেগে। ভারত তখন ৩ উইকেটে ৮৭।
হুট করে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া ভিত আবার কিভাবে শক্ত করতে হয়, চতুর্থ জুটিতে সেটিই দেখালেন মহেন্দ্র সিং ধোনি ও দিনেশ কার্তিক। দুজনের অভিজ্ঞতার ভেলায় আস্তে আস্তে চাপটা সরাতে থাকে ভারত।
তবে বাংলাদেশ হাল ছেড়ে দেয়নি। কার্তিককে ফিরিয়ে ৫৪ রানের জুটি ভাঙেন বাংলাদেশের ‘গোল্ডেন আর্ম’ মাহমুদউল্লাহ। রান তাড়ায় বহু পোড় খাওয়া ধোনিকে থামিয়েছেন মুস্তাফিজ।
খানিক পর হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে উইকেট ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন কেদার যাদব, বাংলাদেশ তখন স্বপ্ন দেখছে নতুন করে। কিন্তু অষ্টম উইকেটে দারুণ বুদ্ধিমত্তা আর ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করে ভারতকে জয়ের কাছে এগিয়ে নিতে থাকেন ভুবনেশ্বর ও জাদেজা। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দুজনের ৪৫ রানের জুটি ছিল মহামূল্য।
বাংলাদেশ তবু হাল ছাড়েনি লড়াইয়ে। ম্যাচ জুড়ে নিজেদের উজার করে বোলিং করেছেন মাশরাফি, রুবেল ও মুস্তাফিজ। শেষ দিকে ফিরিয়ে দেয় ভুবনেশ্বর ও জাদেজাকে। কিন্তু কেদার যাদব আবার মাঠে ফেরেন। শেষ বলটা আবার ফাঁকি দেয় বাংলাদেশকে।
কাছে গিয়েও না পাবার যন্ত্রণা পোড়াবে নিশ্চিত। তবে দলের দুই সেরা ক্রিকেটারকে ছাড়া, ক্লান্তি-শান্তি আর চোটের সঙ্গে লড়াই করে যেভাবে খেলেছে বাংলাদেশ, মাশরাফিরা মাঠ ছাড়তে পারে গর্ব ভরে, মাথা উঁচু করেই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৮.৩ ওভারে ২২২ (লিটন ১২১, মিরাজ ৩০, ইমরুল ২, মুশফিক ৫, মিঠুন ২, মাহমুদউল্লাহ ৪, সৌম্য ৩৩, মাশরাফি ৭, নাজমুল ৭, মুস্তাফিজ ২*, রুবেল ০; ভুবনেশ্বর ০/৩৩, বুমরাহ ১/৩৯, চেহেল ১/৩১, কুলদীপ ৩/৪৫, জাদেজা ০/৩১, কেদার ২/৪১)।
ভারত: ৫০ ওভারে ২২৩/৭ (রোহিত ৪৮, ধাওয়ান ১৫, রায়ডু ২, কার্তিক ৩৭, ধোনি ৩৬, কেদার ২৩*, জাদেজা ২৩, ভুবনেশ্বর ২১, কুলদীপ ৫*; মিরাজ ০/২৭, মুস্তাফিজ ২/৩৮, অপু ১/৫৬, মাশরাফি ১/৩৫, রুবেল ২/২৬, মাহমুদউল্লাহ ১/৩৩)।
ফল: ভারত ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: লিটন দাস
সূত্রঃ বিডিনিউজ