অনলাইন ডেস্কঃ
নাশকতার ছক আঁকার তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে বলেই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা – ওবায়দুল কাদের
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার হঠাৎ করে হার্ডলাইনে। বিশেষ করে গত সোমবার রাজধানীর ৩২ থানায় শীর্ষ নেতারাসহ বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দায়েরের পর এটাই এখন দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়। সরকারের সংশ্নিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, আগামী ১০ অক্টোবর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নাশকতা ঠেকাতে এবং বিএনপিকে চাপে রাখতেই এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো না হলেও ক্ষমতাসীন দলটির কোনো কোনো নেতা দাবি করেছেন, নাশকতা সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নামে নাশকতার ছক আঁকার তথ্য রয়েছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ বলেছে, বিএনপি নেতারা ২০১৪ সালের মতো গোপনীয়ভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতার পরিকল্পনা করছেন। আর এ ধরনের অভিযোগে পুলিশ যদি কারও বিরুদ্ধে মামলা করে, সেটা কি হয়রানিমূলক মামলা হবে? তবে কারও বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা হোক- আওয়ামী লীগ সেটি চায় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রোববার বিএনপির সমাবেশের পর থেকে এমনিতেই মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত হওয়ার আভাস মিলছিল। ওই সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দু’দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে বিএনপি। এ অবস্থায় গত সোমবার বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আন্দোলনে নামার আরেকটি ইস্যু পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ সমকালকে বলেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তারা নিজেদের সম্মান রাখতে পারেনি। বিএনপি নিজেদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে রাখেনি- ভাংচুর ও বাড়াবাড়ি করেছে। আগামীতে এমন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখলে তাদেরই ক্ষতি হবে। সরকার আরও হার্ডলাইনে যাবে। তিনি আরও বলেন, আগামী ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা হবে। তাই এ নিয়ে বিএনপি ষড়যন্ত্র করতেই পারে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যই ওই নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা স্বাভাবিক।
এদিকে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে সরকারবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া এবং গাড়ি ভাংচুর ও পুলিশের কাজে বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতার অভিযোগে সোমবার বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা ওই মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা গতকাল জানিয়েছেন, বিএনপি আগামীতে নাশকতামূলক ঘটনার অপচেষ্টা করলে শক্তভাবে তা মোকাবেলা করা হবে। কোনোভাবেই ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, মানুষ পরিবর্তন চাইছে। অথচ বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আদলে আরেকটি মনগড়া নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করছে। এ জন্যই নতুন করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা নিয়ে বিএনপি তো কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। উল্টো সরকার মানুষকে সভায় আসতে দেয়নি। এখন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের বাদ দিয়েই কি নির্বাচন হবে? এ নেতারাই নির্বাচনের সময় দলের পক্ষ থেকে কথা বলবেন। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কেন অসত্য মামলা দেওয়া হলো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগেই মামলা হয়। আর সরকারবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য, গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের কাজে বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতার অভিযোগে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ ও দেশের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি। ষড়যন্ত্র করে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়াটা রাজনৈতিক দলের কাছে কারোরই কাম্য নয়।
আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় নিয়ে নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিনি রাজনীতিবিদদের নাশকতা ও ষড়যন্ত্র থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান।
এদিকে, গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ওই মামলার মূল আসামি হওয়ায় এই আশঙ্কা বেশি করে দানা বেঁধেছে। এ নিয়ে সরকার আরও হার্ডলাইনে যাচ্ছে। সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে বিএনপি নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে। এই নাশকতায় উস্কানিদাতা হিসেবে যুক্ত হতে পারেন- বিএনপির এমন শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করারও প্রস্তুতি রয়েছে। আবার এ রায়কে ঘিরে বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামার প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
তবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে যেতে চাইছেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা নিজেদের দলীয় কর্মসূচি নিয়েই মাঠে সক্রিয় থাকবেন। বিশেষ করে নির্বাচনের মাত্র অল্প কিছুদিন সময় বাকি থাকায় গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণার দিকে মনোযোগী রয়েছেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে আকাশ, ট্রেন ও সড়কপথে নির্বাচনী যাত্রার সফল সমাপ্তির পর এখন দেশজুড়ে গণসংযোগ কর্মসূচিতে রয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পর্যন্ত নানা কর্মসূচিতে মাঠ দখলে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
এদিকে, নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ নিয়ে তারা মাঠে না নামলেও গতকাল কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দলটির নেতারা। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একতরফা নির্বাচন করতেই সরকারের সাজানো ছকে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, মামলা ও গ্রেফতারের জন্য পুলিশের কাছে আষাঢ়ে গল্পের একটা ফরম্যাট সব সময় প্রস্তুত করা থাকে। এবারও পুলিশ তাই করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় পুলিশ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে হাস্যকর, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়েছে।