সমকালঃ
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা হলেও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মামলার কথিত তদন্তে তার কোনো বক্তব্যই নেওয়া হয়নি। এমনকি মামলার আলামত নষ্টের অপচেষ্টা ও জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে ইতিহাসের নৃশংসতম এ ঘটনাটি ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা হয়। অবশ্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিদায়ের পর এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটি নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ওই সময় মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি ১৬১ ধারায় শেখ হাসিনার জবানবন্দি নেয়।
সেদিনের সেই ঘটনা সম্পর্কে ২০০৭ সালের ২২ নভেম্বর শেখ হাসিনা জবানবন্দি দেন। ওই সময় তিনি মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি ছিলেন। সাব-জেলে গিয়ে জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিআইডির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল কবির। তার এই জবানবন্দিতে ঘটনার দিন সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ আয়োজনে পুলিশের অসহযোগিতা, গ্রেনেড, গুলি, নেতাকর্মীদের মৃত্যু, তাকে রক্ষায় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তৈরি করা মানবঢালসহ নানা বিষয় উঠে আসে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার বয়স ৬১ বছর। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। অদ্য ২২/১১/০৭ইং তারিখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীন শেরেবাংলা নগরস্থ বিশেষ সাবজেলে আপনাকে, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির জেনে এই জবানবন্দি প্রদান করছি যে, ২১শে আগস্ট ২০০৪ইং ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা এবং গোপালগঞ্জে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মুক্তাঙ্গনে একটি প্রতিবাদ র্যালি করার জন্য কয়েক দিন পূর্বে অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করা হয়। কিন্তু ২০ আগস্ট ২০০৪ইং তারিখ সকাল পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মুক্তাঙ্গনে র্যালি করার অনুমতি না দেওয়ায় আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনে র্যালি করার জন্য প্রস্তুতি নেই। পত্রপত্রিকাতে সেইভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২১শে আগস্ট ২০০৪ ইং তারিখ বিকাল সাড়ে ৪টায় আমি সুধাসদন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর র্যালির উদ্দেশে রওনা হই। আমার গাড়িবহর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পৌঁছার পর আমি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত ট্রাকে উঠি। ট্রাকের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ গজ পূর্ব দিকে। ট্রাকটি পূর্বমুখী অবস্থায় ছিল। ট্রাকের পেছনের দিকে রক্ষিত কাঠের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে আমি কর্মী, সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখি।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পুলিশের কাছে দেওয়া তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘বিকাল ৫টা ২২ বা ২৩ মিনিটে সময় আমার বক্তৃতা শেষ হয় এবং আমি ট্রাক থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম। এই সময় ফটো সাংবাদিক গোর্কি (এস এম গোর্কি) আমাকে বলে, সে ছবি নিতে পারে নাই। যখন আমি তাকে ছবি নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য একটু থামি, ঠিক তখনই সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বিস্ম্ফোরণের শব্দ হয়। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে আমরা যারা ট্রাকের ওপর ছিলাম, সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে, বসে পড়ি। এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি বিস্টেম্ফারণ ঘটে। ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে।’
শেখ হাসিনা পরবর্তী পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জবানবন্দিতে বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর বিস্টেম্ফারণ একটু থামলে কর্মীরা আমাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে আমার বুলেটপ্রুফ জিপ গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। আমি জিপের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আবারও বিস্টেম্ফারণ শুরু হয়। আমাকে টেনে ট্রাকে রক্ষীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুনরায় মানববর্ম তৈরি করে নেতাকর্মীরা আমাকে রক্ষা করার জন্য তৎপর হয়। এরপরে এক পর্যায়ে আমাকে বুলেটপ্রুফ জিপে তোলা হয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার সময় আমি সুধাসদনে পৌঁছাই। ওই দিন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় আমার জিপ যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আউটার স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন পুলিশ টিয়ারশেল ব্যবহার করে ও শটগান থেকে গুলি করে আমাদের যাত্রাকে ব্যাহত করেছিল। আমি যখন গাড়িতে উঠি তখন কয়েকটি গুলির শব্দ শুনি, তবে কারা গুলি করে বা কোন দিক থেকে গুলি হচ্ছিল, তা বুঝে উঠতে পারি নাই। ঘটনার সময় এসবির প্রটেকশন টিমের সদস্যরা তাদের অস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও ডিএমপির প্রটেকশন দল কোনো ভূমিকা রাখে নাই। উপরন্তু, ডিএমপি পুলিশ সদস্যরা আহতদের সাহায্য না করে সাহায্যকারীদের লাঠিপেটা করেছে। এই ঘটনায় আমার বুলেটপ্রুফ গাড়িটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সভা মঞ্চের ট্রাকে আমি ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরউল্লাহ, শেখ সেলিম, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে জানতে পারি সেগুলো ছিল গ্রেনেড বিস্ম্ফোরণ। উক্ত গ্রেনেড বিস্ম্ফোরণের ফলে মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ আমাদের দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং শত শত নেতা, কর্মী, সমর্থক আহত হয়। অনেকে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার পরও পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই ঘটনায় আমার শ্রবণশক্তি খোয়া যায়। বিদেশে চিকিৎসার পরও আমার ডান কানের শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক হয় নাই। এ ঘটনায় মৃত ২২ জন ছাড়াও আরও দুটি অশনাক্ত লাশ ছিল।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার দেওয়া জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘সাধারণত এই ধরনের জনসভা বা র্যালি হলে সভামঞ্চের আশপাশের দালানের ছাদে এবং বিভিন্ন ফ্লোরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারায় থাকে। কিন্তু ওইদিন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের ওই সকল দালানের ফ্লোরে বা ছাদে অবস্থান করতে দেওয়া হয় নাই।’