অনলাইন ডেস্কঃ
একুশে অগাস্টের হামলাস্থল থেকে উদ্ধার অবিস্ফোরিত গ্রেনেড আলামত হিসেবে রাখতে চাওয়ার পর চাকরি হারাতে হয়েছিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন বোম্ব ডিসপোজেবল কোম্পানির অধিনায়ককে।
আলোচিত এই মামলার রায়ের পর বুধবার সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা সামসুদ্দীন আহমদ সামস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন সেই সময়কার কথা; ঘটনাস্থলে তিনি কী দেখেছিলেন, কীভাবে তাকে পাঠানো হল অকালীন অবসরে।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর আলামত গোপনের অভিযোগ তখনই তুলেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
পরে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দও বলেন, আলামত নষ্ট করে ফেলায় তার কাজ কঠিন হয়ে উঠেছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাশ করতে যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল, তা বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়েও উঠে এসেছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সামস এই মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতেও ওই দিনের ঘটনা তুলে ধরেন। সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার কথাও বলেন তিনি।
সামসুদ্দীন সামস তখন ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন সেনাবাহিনীতে।
“আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে একটা কোম্পানিতে ছিলাম। আমার কোম্পানিটা মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল। সেটা একটা ব্রিগেডের আন্ডারে ছিল। ব্রিগেডের তিনটা ব্যাটালিয়ন ছিল, একটা স্বতন্ত্র কোম্পানি ছিল। আমি সেই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলাম।”
শেষ বিকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর রাতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন সামস, তার কোম্পানির সদস্যদের নিয়ে।
তিনি বলেন, “রাত সোয়া ১০টার দিকে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। দূর থেকে দেখানো হল দুইটা গ্রেনেড আছে। কিন্তু সেখানে আলামত সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা দেখিনি। পুলিশের ঊর্ধতন কোনো কর্মকর্তা সেখানে ছিল না। একজন কনস্টেবলকে সেখানে দেখতে পেয়েছিলাম।
“ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর প্রতিনিয়ত কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম। আমাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যেন সাংবাদিকদের বেশি কিছু না বলি।
“ওই রাতে দুইটা আর্জেস গ্রেনেড পেয়েছিলাম। সেগুলো ছিল অত্যন্ত শক্তিসম্পন্ন। একেকটি গ্রেনেডে চার হাজার স্প্লিন্টার ছিল। যদি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে একটি স্প্লিন্টারও কাউকে আঘাত করে, তাহলে সেই ব্যক্তিরও মৃত্যু হতে পারে।”
সেদিন ডজন খানেক গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হন আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী। আহত কয়েকশ জনের অনেকে এখনও স্প্লিন্টার দেহে নিয়ে বেঁচে আছেন।
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে পাওয়া দুটি আর্জেস গ্রেনেড ওই রাতেই ধ্বংস করা হয়েছিল। পরদিন আরও দুটি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধারের পর সেগুলো সেনানিবাসে নিয়ে এসেছিলেন বলে জানান তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা সামস। তিনি বলেন, তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারাও সেগুলো দেখেন।
তার ভাষ্য, আলামত হিসেবে ওই দুটি গ্রেনেড তিনি রাখতে চাইলেও তাকে রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। পরে সেগুলো ধ্বংস করা হয়।
সামস বলেন, “ওইদিন রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে এমন একটা আলামত না রাখার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল, এই কাজটা তো মোটেই ভালো কোনো কাজ হল না। এখন এসব বুঝতে পারছি। তখন সরল বিশ্বাসে বলেছিলাম, আলামত রাখতে চাই। তখন বুঝতে পারিনি, কেউ সেগুলো রাখতে চাইছে না।”
তিনি বলেন, “কেন, কী দরকার এসব আলামত রাখার, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছিল। কিন্তু নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে পেশাগত দায়িত্ব থেকে আলামত রাখার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ওরা চাচ্ছিল, আমিও যেন বলি, আলামত রাখাটা ঠিক হবে না। কিন্তু আমি সত্য উদঘাটন করতে চেয়েছিলাম।”
আওয়ামী লীগের সমাবেশে ওই হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়েছে মামলায়। মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর তৎকালীন দুই কর্মকর্তা এটিএম আমিন আহমদ ও সাইফুল ইসলাম জোয়ারদারেরও সাজা হয়েছে এই মামলায়। সাবেক তিন পুলিশ প্রধান মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক, খোদা বক্সকেও এই মামলায় সাজা দিয়েছে আদালত।
গ্রেনেড হামলার ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে সামসকে প্রথমে বদলি করে পাঠানো হয় নাটোরে। তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারিও চলতে থাকে। জানুয়ারি মাসে তাকে পাঠানো হয় অকালীন অবসরে।
“আমার মেজর হওয়াটা তখন অনেকটাই নিশ্চিত ছিল, কিন্তু তা আর হয়নি। তার আগেই অকালীন অবসরে যেতে হয়েছে,” বলেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড রাজনৈতিক দলের উপর ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের উপর পৈশাচিক আক্রমণ?
“শুধু আক্রমণই নয়, দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সামস বলেন, “এই মামলায় আমি সাক্ষী ছিলাম। আমি মনে করি ভালো রায় হয়েছে, সুন্দর রায় হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, সত্য উদঘাটন হয়েছে।
“আমরা চাই, যেই ক্ষমতায় থাকুক এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। দেশটার ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন সবার মধ্যে যেন সহমর্মিতা কাজ করে।”
সূত্রঃ বিডিনিউজ