অনলাইন ডেস্কঃ
পূর্ব মাদারবাড়ি থেকে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠ, শোকাকূল ভক্তের স্রোত ছুটেছে প্রিয় শিল্পীকে শুধু একটিবার চোখের দেখা দেখতে।
কারো চোখে কান্না ঝড়েছে। কেউ নিরবতায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রিয় আইয়ুব বাচ্চুকে।
ফুলে আর ভালোবাসায় নিজেদের প্রিয় সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে এভাবেই জড়ো হয় চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ।
কথা আর সুরের মায়াবি মোহে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আইয়ুব বাচ্চু কাছে টেনেছেন স্রোতাদের, ভাসিয়েছেন অনুভূতির বহুবর্ণিল সাগরে।
মৃত্যুর পরও সেই একই জাদুতে টেনেছেন ভক্তদের। সব স্রোতের গন্তব্য তাই সুর স্রষ্টার পানে, শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে।
শনিবার দুপুর থেকে হাজার হাজার মানুষের শোক মিছিলের গন্তব্যে পরিণত হয় নগরীর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠ।
ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে কয়েকশ পুলিশ সদস্যকে।
‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’- বলে চলে যাওয়া বাচ্চুর প্রয়াণ কত কষ্ট দিয়েছে ভক্তদের মনে তা প্রমাণ হয় তাদের প্রাণের আকুতিতে।
জানাজার জন্য তৈরি অস্থায়ী মঞ্চের পাশে বাচ্চুর ছবি সংবলিত ব্যানার ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. আলী।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে মো. আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এনায়েত বাজারের বাচ্চু, আলকরণের কুমার বিশ্বজিৎ আর ফিরিঙ্গিবাজারের আমি। স্কুল ভিন্ন কিন্তু গানের সুরে সুরে বন্ধুত্ব।
“বিকেল থেকে গভীর রাতে পুরো শহর ঘুরে বিয়ে বাড়ি, গায়ে হলুদ, জন্মদিনসহ নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়াতাম। তখন ১৩-১৪ বছর বয়স।”
শৈশবের সে বন্ধুত্ব অটুট ছিল বিদায় বেলাতেও।
মো. আলী বলেন, “ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার সময় ফোন করে বলত- বিমানে উঠছি। এখানে বিমান থেকে নেমেও জানাত।
“তারপর বলত আমি হোটেলের পথে, তুইও চলে আয়। আমাদের সবার আগে সে চলে গেল।”
জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠের অদূরে সার্কিট হাউজের মাঠে রাত জেগে গানের আড্ডায় যোগ দিতেন সোলস ব্যান্ডের সুব্রত বড়ুয়া রনি।
তিনি বলেন, “এত আগে এভাবে ওর চলে যাওয়া মেনে নেওয়ার মত না। চট্টগ্রামের মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে তার প্রমাণ আজ হল।”
প্রিয় শিল্পীকে শেষবার দেখতে যেমন বন্ধুরা এসেছিলেন তেমন এসেছেন তরুণ-কিশোর আর শিশুরাও।
আগ্রাবাদ থেকে ১০ বছরের কিশোর হৃদয় এসেছিল আইয়ুব বাচ্চুকে এক নজর দেখতে। কিন্তু ততক্ষণে ঘড়ির কাটা চারটা পেরিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে মরদেহবাহী গাড়ির জানালা। তাই আর দেখা হল না প্রিয় শিল্পীকে। তবু গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল হৃদয়।
সড়কের নামকরণের আশ্বাস, আবক্ষ ভাস্কর্যের দাবি:
জানাজার আগে মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আইয়ুব বাচ্চু চট্টগ্রামবাসীর গর্ব।
“আমাকে বলেছিল- চট্টগ্রামে একটা বাড়ি করতে চায়। এখানে থাকতে চায়। এখন দাবি উঠেছে একটা সড়ক বা কিছু তার নামে নামকরণের। সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”
এর আগে দুপুরে পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় বাচ্চুর নানা বাড়িতে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির জানান, চট্টগ্রামের মুসলিম ইন্সটিটিউট হলের একাংশের নামকরণ আইয়ুব বাচ্চুর নামে করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
জানাজার মাঠে নগরীর নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির মোড়ে আইয়ুব বাচ্চুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি তোলেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম।
সে ব্যাপারেও আশ্বাস দেন মেয়র।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে স্মৃতিচারণ করেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদত হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, নগর যুবলীগ আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
গিটারে শেষ বিদায়
‘গিটারের জাদুকরকে’ গিটার আকৃতির ফুলের তোড়ায় বিদায় জানিয়েছে ভক্তরা।
রিদম মিউজিক্যাল শপ ও নোঙর বাড়ি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে ফুলে তৈরি গিটার দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় আইয়ুব বাচ্চুকে।
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, সোলস, চিটাগাং মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনসহ শতাধিক সংগঠন।
ফুলে ফুলে ঢেকে যায় আইয়ুব বাচ্চুকে বহনকারী গাড়িটি।
জানাজার নামাজের পরও ভক্তদের স্রোত ছুটতে থাকে মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের দিকে।
সাইরেন বাজিয়ে তখন ছুটে চলে শেষ যাত্রার বাহন। গন্তব্য বাইশ মহল্লা চৈতন্য গলি। তখনো হাজারো ভক্ত ছুটছে সেই গাড়ির পেছনে।
জমিয়তুল ফালাহ থেকে ভক্তদের শোক মিছিল গিয়ে শেষ হয় বাইশ মহল্লার কবরস্থানে। মায়ের পাশে সেখানেই শেষ ঠিকানা বাচ্চুর।
একদিন যে শহর থেকে ‘হারানো বিকেলের গল্প’ দিয়ে শুরু হয়েছিল সুরের যাত্রা, সারা বিশ্বে জয়রথ ছুটিয়ে আরেক বিষন্ন বিকেলেই চিরতরে হারিয়ে গেলেন বাংলা ব্যান্ডের বরপুত্র।
তখনও হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের চোখে জল, সাদা কাগজের বুকে কালো কালিতে লেখা ‘ভালোবাসি স্যার’।
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অঙ্গনে ‘গিটারের জাদুকর’ হিসেবে খ্যাত আইয়ুব বাচ্চু গত বৃহস্পতিবার ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
শনিবার বেলা ১১টায় ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।
বিমানবন্দর থেকে আইয়ুব বাচ্চুর কফিন নেওয়া হয় বন্দরনগরীর পূর্ব মাদারবাড়িতে তার নানা বাড়িতে। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় নানা বাড়িতেই কেটেছে।
সূত্রঃ বিডিনিউজ