বান্দরবানে থানছি উপজেলার দুই হাজার জুমিয়া পরিবার খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। দুর্গম এই পাহাড়ি এলাকার এই বাসিন্দারা বর্ষায় সঙ্কট আরও বাড়বে বলে উদ্বিগ্ন।
অতিবৃষ্টির কারণে জুম চাষ করতে না পারায় এবং করলেও ফলন ভালো না হওয়ায় দুর্গম ইউনিয়ন রেমাক্রি ও তিন্দুতে বসবাসরত পাহাড়িরা চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন বলে খবর মিলছে।
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ওই এলাকায় গত কিছু দিন ধরে খাদ্য সঙ্কটের খবর পেয়ে তা মেটাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানায়, দুর্গম পাহাড়ে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় জুম চাষ। গত বছর অতিবৃষ্টির কারণে অনেকেই জুম চাষ করতে পারেনি। যারা করেছে ভালো হয়নি ফসল। যার কারণে দেখা দিয়েছে এ খাদ্য সঙ্কট।
ভাতের চালের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় রেমাক্রি ও তিন্দুতে অভাবি মানুষরা এখন বুনো আলু, ফলমূল, কলার মোচা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়।
এদের সাহায্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে না এলে চলতি বর্ষায় খাদ্য সঙ্কট ব্যাপক আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
রেমাক্রি ইউনিয়নে বড়মদক থেকে দেড়ঘণ্টা পায়ে হাঁটার দুরত্ব য়ংনং কারবারি পাড়া। সেখানে ১৭ ম্রো পরিবারে বাস।
ওই পাড়ার বাসিন্দা ৮০ বছরে রুইমন ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বড় দুঃখে পড়েছি। ঘরে ভাত নাই। বন্য আলু সংগ্রহ করে খাই। কেউ খোঁজ-খবর না নিলে আমরা না খেয়ে মরে যাব।”
একই পাড়ার আদুই ম্রো (৬০) ও য়ুংওয়াই ম্রো (৫৬) জানান, গত বছর বৃষ্টি হওয়ায় জুম চাষ তেমন হয়নি।
কারবারি পাড়ার পাশে ১৮টি পরিবারের মারমা পাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, তিন-চার পরিবারে লোকজন ছাড়া কেউ নেই। সবাই জুমে কাজ করতে গেছে। বাড়িতে রয়েছে ছোট ছেলে-মেয়েরা।
কারবারি (পাড়াপ্রধান) ক্রাহ্লাঅং মারমা জানান, পাড়ায় পাঁচ পরিবার ছাড়া কারও ঘরে চাল নেই। দুই-তিন দিন পর এক বেলা ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়। তুলনামূলক স্বচ্ছল ওই পাঁচ পরিবার থেকে পাড়ার অভাবগ্রস্ত লোকজন ধান-চাল ধার নিতে নিতে তাদেরও খাদ্যের জোগান শেষ হওয়ার পথে।
রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাংচং ম্রো বলেন, “এ বছর খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে।”
তার ওয়ার্ডে সীমান্ত এলাকায় পাড়া পাতোয়া, লিক্রি, ঞোয়েতং এবং বুলু পাড়ায় সঙ্কট সবচেয়ে বেশি বলে জানান তিনি।
৫৫ ত্রিপুরা পরিবারের জাপারাং পাড়ার সাজানো-গোছানো ঘরগুলোতে সৌর বিদ্যুৎ থাকলেও খাদ্য সঙ্কট সেখানেও। ওই পাড়ায় মাত্র ১০ পরিবারের ঘরে খাবার আছে বলে জানা গেছে।
পাড়ার বীরেন ও দিয়াম্ব ত্রিপুরা বলেন, তারা আগে কখনও এরকম খাদ্য সঙ্কটে ভোগেননি। গত বছর অতিবৃষ্টি এবং জুমের ফসলে পোকা ধরায় ধান কম হয়েছে। ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সীমান্ত এলাকায় বিজিবির দুটি বিওপি ক্যাম্প থাকায় তাদের মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ করে পাড়ার লোকজন মজুরি হিসেবে ৩০০ টাকা করে যায়। তা দিয়ে কোনোমতে এখন দিন চলছে বলে জানান তারা।
ছোটমদক এলাকায় খুমী পাড়া প্রধান হৈকু খুমী বলেন, মার্চ মাস থেকে জুম ফসলের খাদ্যের জোগান শেষ হয়েছে। চলতি বর্ষায় খাদ্য সঙ্কট আরও বাড়বে।
রেমাক্রি ইউনিয়নে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা বলেন, তার ইউনিয়নে ১৩২০ পরিবার আছে। এর মধ্যে ১ হাজার পরিবার জুমিয়া। এর মধ্যে প্রায় ৯০০ পরিবারে খাদ্য সঙ্কটে রয়েছে।
খোরাক জুগিয়ে নয়, বরং দুর্গম এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান তিনি।
তিন্দু ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মংপ্রুঅং মারমা বলেন, তার ইউনিয়নেও ১২০০ পরিবারের মধ্যে ৭০০ পরিবারে অভাব চলছে।
দুর্গম পাহাড়ি এই এলাকা চলতি বর্ষায় খাল ও ঝিরিতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কেউ কেউ না খেয়ে মারা যেতে পারে বলে শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে থানছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রশাসন দ্রুত চাল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে।
“ইতোমধ্যে রেমাক্রী ও তিন্দু ইউনিয়নে দুর্গত এলাকাগুলোতে ৪৬ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।”
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক দীলিপ কুমার বণিক জানান, অক্টোবর পর্যন্ত এসব দুর্গম অঞ্চলে খাদ্য সঙ্কট থাকার সম্ভাবনার কথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। এ পর্যন্ত দুর্গত এলাকার ২৩০০ পরিবারের মধ্যে ৪৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
[বিডিনিউজ]