ক্রীড়া ডেস্কঃ
২০০ ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ করেছেন প্রথম ওয়ানডেতে। মাশরাফি বিন মুর্তজার অপেক্ষায় এবার আরেকটি দারুণ অর্জন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে টস করলেই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়ার রেকর্ডে ছুঁয়ে ফেলবেন হাবিবুল বাশারকে।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৬৯টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাবিবুল। সব ঠিক থাকলে মঙ্গলবারের ম্যাচটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির ৬৯তম ওয়ানডে।
এমনিতে ব্যক্তিগত অর্জন মাশরাফিকে স্পর্শ করে সামান্যই। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ ওয়ানডে খেলার কীর্তিও যেমন তার কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। ম্যাচের আগে বলেছিলেন, তার ভাবনা জুড়ে কেবল দলের জয়। তবে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্মান বলেই অধিনায়কত্বের রেকর্ড খানিকটা দোলা দিচ্ছে তার মনে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন সেই রোমাঞ্চের কথা।
“দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারাই বড় ব্যাপার। নেতৃত্ব সেখানে অনেক বড় সম্মান। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দিতে পারা তাই বিশেষ কিছু। তবে এখনও তো খেলছি, এখন যতটা অনুভব করব, এই অর্জনের ভালো লাগা হয়তো ক্যারিয়ার শেষে আরও বেশি করে বুঝতে পারব। পেছন ফিরে তাকালে এগুলোই হয়তো বেশি তৃপ্তি দেবে।”
পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি। অনেকের মতে, নেতৃত্বগুণেও সেরা তিনি। তবে মাশরাফি নিজে বরাবরই বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক মনে করেন হাবিবুলকে। তাই পরিসংখ্যানে পাশে বসলে বা সামনে ছাড়িয়ে গেলেও মাশরাফি বাস্তবতায় এগিয়ে রাখছেন হাবিবুলকেই।
“সবসময়ই বলে আসছি, সুমন ভাই (হাবিবুল) বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সবচেয়ে কঠিন সময়ে। অনেক সীমাবদ্ধতার ভেতরও দলকে জিততে শিখেছে ওই সময়ে। তার সময়ের সঙ্গে আসলে আমাদের তুলনা চলে না। তার আগে বাংলাদেশের কোনো অধিনায়কই মনে হয় এক-দেড় বছরের বেশি টিকতে পারেননি। দল হারত, অধিনায়কের কাজ ছিল কঠিন। সেই সময়ে সুমন ভাই তিন-চার বছর অধিনায়কত্ব করেছেন। তার ৬৯ ম্যাচ আসলে আমার ৬৯ থেকে অনেক এগিয়ে।”
লড়াই কম করতে হয়নি মাশরাফিকেও। ২০০১ সালে অভিষেকের পর চোট-আঘাতের সঙ্গে নিত্য যুদ্ধ করে এগিয়ে নিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ার। নেতৃত্ব পান ২০০৯ সালে। কিন্তু নেতৃত্বের প্রথম টেস্টেই আবার চোট পেয়ে ছিটকে যান। সেই চোট কাটিয়ে ফিরে ওয়ানডেতে প্রথম নেতৃত্ব দেওয়ার স্বাদ পান ২০১০ সালের ইংল্যান্ড সফরে।
তার নেতৃত্বে দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই ঐতিহাসিক এক জয় পায় বাংলাদেশ। ব্রিস্টলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশকে ওয়ানডেতে হারানোর বৃত্ত পূরণ করে দল। আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস মিলিয়ে সেবার ইউরোপ সফরে ৬টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেন মাশরাফি। ওই বছরের অক্টোবরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবার নেতৃত্ব দেন দেশের মাটিতে। কিন্তু সিরিজের প্রথম ম্যাচেই আরও একবার চোট পেয়ে চলে যান মাঠের বাইরে।
মাশরাফির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময় এসেছে এরপরই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাওয়া চোট কাটিয়ে মাঠে ফিরলেও আবার ছিটকে পড়েন ঘরোয়া ক্রিকেটে পাওয়া চোটে। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার চেষ্টায় আরেক দফা লড়াই শুরু করেন মাঠে ফেরার। লক্ষ্যের কাছাকাছি ছিলেনও। কিন্তু বিতর্কিতভাবে জায়গা পাননি ২০১১ বিশ্বকাপে। এখনও যেটি তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।
তার ক্যারিয়ারের সামনেও প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে গিয়েছিল সেবার। সময়ে সব প্রশ্ন দূরে ঠেলে তিনি ফিরেছেন প্রবল বিক্রমে। আরও চোট এসেছে, প্রতিটি লড়াইয়ে জিতেছেন। ২০১৪ সালে দেশের ক্রিকেটের টানা ব্যর্থতার অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানে আবারও তাকে দেওয়া হয় পথ দেখানোর ভার। রঙিন পোশাকে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়ের সূচনাও সেই থেকে। মাশরাফির নেতৃত্বেই অভাবনীয় সাফল্যের গৌরবোজ্জ্বল পথে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।
ক্যারিয়ারের এই নতুন অধ্যায়ে বিস্ময়করভাবে চোটের কারণে বাইরে থাকেননি একটি ওয়ানডেও। চোট-আঘাত এই সময়েও এসেছে, কিন্তু লড়াই করতে করতে নিজের শরীরকে খুব ভালোভাবে চিনে ফেলা মাশরাফি শিখে গেছেন সব সামলে নিতে। ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে এবার সিরিজের প্রথম ওয়ানডে, এই সময়ে বাংলাদেশের ৬৪ ম্যাচের ৬১টিতেই টস করেছেন তিনি। কেবল বিশ্রাম ও দলের মন্থর ওভার রেটের নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে খেলতে পারেননি তিনটি ম্যাচে – ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ, বিশ্বকাপের পর পাকিস্তান সিরিজের প্রথম ম্যাচ ও গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচ।
অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যে বাংলাদেশের সবাইকে মাশরাফি ছাড়িয়ে গেছেন বেশ আগেই। ৬৮ ওয়ানডেতে অধিনায়ক মাশরাফির জয় ৩৯টি। ৬৯ ম্যাচে হাবিবুলের জয় ছিল ২৯টি। সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ৫০ ম্যাচে জয় এসেছে ২৩টি, ৩৭ ম্যাচে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের জয় ১১টি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের বাকি দুটি ম্যাচই খেললে শেষ ওয়ানডেতে ধরা দেবে আরও দুটি মাইলফলক। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ ওয়ানডে খেলার পর বাংলাদেশের হয়ে ২০০ ওয়ানডে খেলা প্রথম ক্রিকেটারও হবেন মাশরাফি। একই সঙ্গে নেতৃত্বের রেকর্ডে ছাড়িয়ে যাবেন হাবিবুলকে।
আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত অন্তত খেলা চালিয়ে যাবেন, গত কিছু দিনে মাশরাফি বলেছেন বারবার। অধিনায়কত্বের রেকর্ড তাই সমৃদ্ধ হবে আরও। তবে তিনি নিশ্চিত, এই রেকর্ড একদিন নতুন উচ্চতায় তুলে নেবেন সাকিব।
“আমি যেখানেই থামি, আমাকেও একসময় ছাড়িয়ে যাবেন অনেকে। সাকিব তো নিশ্চিতভাবেই আমার চেয়ে বেশি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করবে। ওর সেই যোগ্যতা, সামর্থ্য, সময়, সবই আছে। পরের জনের জন্য রেকর্ডটি অনেক উঁচু তারে বেঁধে দেবে ও। দেশের ক্রিকেটেও আশা করি নতুন মানদণ্ড তৈরি হবে।”
সূত্রঃ বিডিনিউজ