রাশেদা কে চৌধূরীঃ
জীবন সুন্দর। জীবনকে উপভোগ করতে হবে। জীবনে ভালো সময় আসে, খারাপ সময় আসে। রাত গভীর হলে ভোর কাছে আসে। আলো আসবেই, ভালো হবেই। বেছে নিতে হবে জীবনকেই।
নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী সম্প্রতি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। বিষয়টি আমাদের সমাজের এমন এক ভয়াবহতার দিকে নির্দেশ দেয়, যা কখনোই কাম্য নয়। তার সঙ্গে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অরিত্রীদের বয়সে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা গড়ে ওঠার সময়। তাদের মধ্যে অনেক সময় এমন অনুভূতি বিরাজ করে, যা খুবই সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সে সময়ে যদি তারা লাঞ্ছিত বা অপমানিত হয়, তখন তাদের কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নিতে পারে। এটা নিয়ে আমাদের আরও ভাবতে হবে। কারণ, আত্মহনন কখনোই কোনো সমাধান হতে পারে না। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের যেমন হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও তা বুঝতে ও সমাধানের পথ জানতে হবে। কোথায় কোন পরিস্থিতিতে কেন আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা এত অল্প বয়সে নিজেকে একদম না ফেরার দেশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই জায়গায় আমাদের আসতে হবে। তবুও একই কথা বলব, কোনো অবস্থায়, কখনোই আত্মহননের কথা ভাবা যাবে না।
আমাদের সামনে অনেক সমাধান তো রয়েছে। সরকার কর্তৃক জারি করা পরিপত্র ও বিধিমালা আছে। মহামান্য আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো শিক্ষার্থীদের জানতে হবে। কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে প্রতিবাদ করার অনেক জায়গা, সময় ও সুযোগ আছে, সেটিও জানতে হবে। সেখানে সে যদি পরিবারের সহযোগিতা না-ও পায়, তারও বিকল্প রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা যেমন দেখছি বাল্যবিবাহ রোধে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সচেতন হয়ে এগিয়ে আসছে। এখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা হটলাইন আছে—৯৯৯। লাঞ্ছিত শিক্ষার্থী কিন্তু সেখানে কল দিতে পারে, অভিযোগ করতে পারে। পরিবার যদি তাকে সহযোগিতা না করে থাকে, তাহলে সে তার কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যে তাকে সহায়তা করতে পারে, তাকে বিষয়গুলো জানিয়ে সাহায্য চাইতে পারে।
দ্বিতীয় যেটা বলতে চাই, পরিবারকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পরীক্ষার চাপে থাকে সব সময়। তার ওপর বাড়িতেও যদি নানাভাবে তাকে বকাবকি বা হেয় করা হয়, তখন কিন্তু তার নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। যে বয়সে অরিত্রীরা চলে যায়, আত্মহননের পথ বেছে নেয়, সে বয়সটা যে খুবই সংবেদনশীল, সেটি পরিবারগুলোকেও অনুধাবন করতে হবে। এভাবে সন্তানকে হেয় করা যায় না, শুধু শাসন নয়, আদর করে যুক্তিসহকারে তাকে বোঝাতে হবে এটা ভুল করার বয়স, কিন্তু ভুল শোধরানোর দায়িত্বও তো অভিভাবকদের নিতে হবে।
এবার বলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা। এখানে শিক্ষকদের ভূমিকা মুখ্য। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে সম্পর্ক ছিল, সেই স্বর্ণযুগটা পার হয়ে গেছে! তখন শিক্ষা কোনো পণ্য হয়ে ওঠেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। কোচিংয়ের জটিলতা ছিল না। যেটা ছিল, সেটা নিজেদের শিখন-শিক্ষণ সম্পর্ক। শাসন করেছেন শিক্ষকেরা, কিন্তু অপমান করেননি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে না তাদের কোনো শিক্ষক তাদের আদর্শ (রোল মডেল) হতে পারবেন! বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতির দিককেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। শিক্ষকেরা অবশ্যই শাসন করবেন, তবে সেটা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। অল্প বয়সে শিক্ষার্থী ভুল পথে যেতেই পারে। এ জন্য তাকে বারবার বোঝাতে হবে, এটা তোমার জন্য ঠিক পথ নয়। সঠিক পথে এসো। তাকে কখনোই এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়, যাতে সে অপমানিত বোধ করে, সংবেদনশীল মনে ক্ষত তৈরি হয়। এটা শিক্ষকদের প্রতি আবেদন। তাঁরা শ্রেণিকক্ষের চালিকা শক্তি, আগামীর নেতৃত্ব গড়ার কারিগর। আশা করি তারা অরিত্রীর মতো আমাদের আর কোনো সন্তান যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেবেন।
তৃতীয় বিষয়টি হলো স্কুল পরিচালনার জন্য একটি কমিটি থাকে, যাকে আমরা ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি নাম দিয়ে থাকি। এই কমিটির সদস্যদের দায়দায়িত্ব আছে। স্কুলের ভেতর বা শ্রেণিকক্ষের ভেতরে কী চলছে, তা তাঁদের দেখা দরকার। শুধু ভর্তির সময়, শিক্ষক নিয়োগের সময় তাঁরা যুক্ত হবেন, বাকি সময় শুধু সভাকক্ষে বসবেন আর পরামর্শ দেবেন, তা হবে না। মাঝেমধ্যে শ্রেণিকক্ষে গিয়েও তাঁদের দেখা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলো এক দিনে তৈরি হয়নি। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা অভিভাবক সমাবেশে আলাপ-আলোচনা করবেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবেন। এটা খুবই প্রয়োজন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শিক্ষা, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এখন ঢালাওভাবে বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা হয়েছে পরীক্ষা ও ফলাফলকেন্দ্রিক। উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীকে চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এ পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীরা হিমশিম খায়, অভিভাবকেরা কোচিং শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে যান। শিক্ষকেরা মনে করেন, এ প্রতিযোগিতার বাজারে তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে শতভাগ জিপিএ-৫ পেতে হবে! এ কারণে শিক্ষকেরা নিজেরা চাপে থাকেন, শিক্ষার্থীদের ওপর একধরনের চাপ প্রয়োগ করেন। আমার মনে হয়, আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি সংস্কারের কথা জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত।
তরুণেরা এখন আগের চেয়ে বেশি আত্মহত্যা করছেন। এর অন্যতম একটি কারণ হলো কর্মসংস্থানের অভাব। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়ার দরকার আছে। তাঁদের জন্য একধরনের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁরা বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন, কখনো মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, আবার কখনো আত্মহননের পথ বেছে নেন। সেখানে আমাদের পরিবারগুলোর একটু চোখকান খোলা রাখার বিষয় আছে। প্রয়োজন হলে তাঁকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, দরকার হলে বোঝাতে হবে যে আত্মহনন কোনো সমাধান নয়।
জীবনকে ভালোবেসে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। চলার পথে ঝুঁকি, চড়াই-উতরাই থাকবেই। হতাশায় ভুগলেই আত্মহননের কথা চিন্তা করা উচিত নয়। ক্ষণজন্মা নারী বেগম রোকেয়া পড়ালেখার সুযোগ পাননি। এরপরও কি তিনি থেমে থেকেছেন? অফুরন্ত আত্মবিশ্বাসসহ সামনে এগিয়ে গেছেন। জীবনের গল্প অবশ্যই ছোট নয়। নিজের কাজ দিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে। শিক্ষক বকুনি দিলে সেটাকে অপমান ভাবব কেন? অপমানিত হলে সেটারও প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। আরেকটি বিষয় হলো, সবাইকে কেন চাকরিবাকরির বাজারে ঢুকতে হবে। তরুণেরা নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারেন, উদ্ভাবনী প্রয়াস নিতে পারেন। সরকার এ ক্ষেত্রে অনেক সহযোগিতা দিচ্ছে। তাই বলব, আত্মহত্যা নয়, ভালো-মন্দকে স্বীকার করে নিয়ে নিজের জীবনকে উপভোগ করতে শিখতে হবে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সব সময় মসৃণ না-ও হতে পারে, তাই বলে নতিস্বীকার করা তো মানুষের পরিচয় হবে না।
পরিসংখ্যান
বিশ্ব
● পৃথিবীতে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে
● প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৬০ হাজার জন
● বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আত্মহত্যার সংখ্যা হবে বছরে সাড়ে ১৫ লাখ
● পৃথিবীতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।
● দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি (বছরে প্রতি লাখে ২৯ জন)।
● ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সব মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের আগে আর ৭৫ শতাংশই শুরু হয় ২৫ বছর বয়সের আগে! অর্থাৎ বিষণ্নতা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগগুলো এই বয়সেই বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ
● বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার।
● বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে।
● গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই–তৃতীয়াংশই নারী, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১১ থেকে ২৫ বছর।
● বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মেন্টাল হেলথ স্ট্যাটাস অব অ্যাডলসেনস ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া: এভিডেন্স ফর অ্যাকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ ছেলে ও ৬ শতাংশ মেয়ে।
● বাংলাদেশে আগে থেকে আত্মহত্যার কল্পনা করে ৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। কল্পনায় আত্মহত্যার বিষয়টি ঘুরপাক খায় ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে।
আত্মহত্যা বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন
● আত্মহত্যার খারাপ দিক সম্পর্কে জনগণকে জানান।
● আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়—লেখার সময় তা মাথায় রাখুন। একই সঙ্গে আত্মহত্যাকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করে, এমন ভাষা পরিহার করুন।
● পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে আত্মহত্যার খবর ছাপাবেন না। আবার ঘটনার অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক।
● লেখায় আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টার রগরগে বর্ণনা দেবেন না। যে স্থানে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বর্ণনা দেওয়া থেকেও বিরত থাকুন।
● বুঝেশুনে শিরোনাম দিন।
● স্থির বা ভিডিওচিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন।
● তারকাদের আত্মহত্যার খবর উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিন।
● আত্মহত্যায় মৃতের স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন।
● কোথায় ও কীভাবে সাহায্য চাইতে হবে, সে তথ্য দিন।
● খোদ সংবাদকর্মীরা আত্মহত্যার খবর থেকে প্রভাবিত হতে পারেন। তা-ও মাথায় রাখুন।