অনলাইন ডেস্কঃ
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর করে আসা পর্যবেক্ষকরা। তারা মনে করেন, মিয়ানমারের ক্রমাগত অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ দ্রুত এ সংকট সমাধানের দিকে এগোতে পারছে না। রবিবার (২৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: গ্লোবাল রেসপন্স’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়। গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করেছিল ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন।
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহানের সঞ্চালনায় আয়োজিত এ গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন– এশিয়াভিত্তিক ইংরেজি ম্যাগাজিন এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক ডানকান বারলেট, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ, অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহমেদ, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক রহমান, যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এসটিভির অনুষ্ঠানপ্রধান ফারহান মাসুদ খান, লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, ঢাকা ট্রিবিউনের প্ল্যানিং এডিটর আসিফ ইসলাম, বাংলা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার উদিসা ইসলাম এবং সিনিয়র রিপোর্টার নুরুজ্জামান লাবু প্রমুখ।
বৈঠকে অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকট শুধুমাত্র স্থানীয়ভাবে সমাধানের কথা বলছি কিন্তু মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকার বিষয়ে কিছুই বলছি না। এই সংকট নিরসনে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রশংসা করাটাই যথেষ্ট নয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। রাজনৈতিক উদ্যোগগুলোও এক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের জন্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আলোচনা বা সভা-সেমিনারও করা হয়নি।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটটি দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে চীন, ভারত ও রাশিয়া বাংলাদেশকে চাপে রাখছে। অন্যদিকে একপাক্ষিকভাবে বিষয়টি সমাধান করতে চাওয়ায় বাংলাদেশও চাপের মুখে পড়েছে। এ কারণে কোন উপায়টি সমস্যা সমাধানে অনুসরণ করা হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার হলো চীনের একটি বড় অর্থনৈতিক বাজার। যে কারণে তারা সংকট সমাধানে অনীহা দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা শুধুমাত্র এককভাবে বাংলাদেশকেই প্রভাবিত করবে না, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলবে।’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা প্রশ্ন রাখেন, ‘যেহেতু কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে, সেহেতু দক্ষিণ এশিয়াকেই সংকট সমাধানে যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশ আর কতদিন এই সমস্যা মোকাবেলা করবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট এখন আর এককভাবে বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটি এখন বৈশ্বিক বিষয়। বাংলাদেশ এককভাবে এবং দ্বিপাক্ষিকভাবে সংকট সমাধানের জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু একের পর এক প্রতিবন্ধকতা আসছেই। এমনকি রাশিয়া এবং চীন মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়েছে।’
ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, লাওসসহ অন্য এশিয়ান দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ‘সৌদি আরব এবং ওআইসি এক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা পালন করেছে? রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তা না হলে এই সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বেশি ঘনীভূত হতে পারে।
‘গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কোনও অবস্থায় পৌঁছানো যায়নি।’
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধুমাত্র মিয়ানমারেরই ছিল, কিন্তু এখন এটা আমাদেরও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা সমাধানে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক ডানকান বারলেট বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দাতাসংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছে। বিষয়টি অনেক বেশি স্পর্শকাতর। এমনকি যুক্তরাজ্য তাদের সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর চাপপ্রয়োগের চিন্তাভাবনা করছে কিন্তু চীন এবং রাশিয়া দেশটিকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে চীন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন।
বাংলা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার উদিসা ইসলাম বলেন, ‘এই সমস্যা সমন্বিতভাবে সমাধানের জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া যেত, কিন্তু সেটি নেওয়া হয়নি। উল্টো বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে। যা কখনোই কাম্য ছিল না।’
আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।’ যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এসটিভির অনুষ্ঠানপ্রধান ফারহান মাসুদ খান বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে অং সান সু চিই যথেষ্ট, কিন্তু তিনি সেটি চান না।’
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন