আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীঃ
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যু (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন) আকস্মিক নয়, অভাবনীয়। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসাধীন ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে। তিনি বেঁচে উঠে দেশে ফিরবেন কিনা, তা নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল। সে জন্য এই মৃত্যু আকস্মিক নয়; কিন্তু অভাবনীয় বলছি এ জন্য যে, বয়সে তিনি এখনও তারুণ্যের শেষ সীমা পেরোননি। সুতরাং দুরারোগ্য ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি আরও কিছুদিন বাঁচবেন- এই আশাই সকলে করছিলেন।
তার অকালমৃত্যু কেউ আশঙ্কা করেননি। সম্ভবত শেখ হাসিনাও করেননি। তাই এই মৃত্যুপথযাত্রীকেও গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নমিনেশন দিয়েছিলেন এবং তার নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটদাতারাও তার রোগের কথা জেনেশুনে তাকে ভোট দিয়ে এবারও জিতিয়েছিলেন। তার অকালমৃত্যুতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময় একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতাকে হারাল।
৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার যখন লন্ডনের বাসায় বসে এই মৃত্যুসংবাদ পাই, তখন নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেছি। দেশে আওয়ামী লীগের বিশাল নির্বাচন জয়ের আনন্দের ঘোর তখনও কাটিয়ে উঠিনি। তখন এই শোক সংবাদ। ভেবেছিলাম, এবারের ইংরেজি নববর্ষের সূচনায় কোনো শোক-দুঃখের খবর শুনতে হবে না। সেই আশা ব্যর্থ হলো সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে।
আমার অনুজরাই আমার আগে আগে চলে যাচ্ছেন। এই শোক কি সহনীয়? রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এ জন্যই লিখেছিলেন, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।’ এই অভিশাপ আমিও এখন বহন করছি। নইলে আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট সৈয়দ আশরাফ, আমিনুল হক বাদশা- এদের অবিচুয়ারি আমাকে লিখতে হচ্ছে কেন? সৈয়দ আশরাফ যখন লন্ডনে এবং মন্টিফিয়োরি সেন্টারে একটি বাংলাদেশি কমিউনিটি সংস্থায় চাকরি করেন, তখন আমিনুল হক বাদশাকে (তিনিও তখন ওই সেন্টারে কাজ করতেন) নিয়ে প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন। বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আমরা তখন যুক্ত। তখন বাদশা আর আশরাফ প্রস্তাব তুলেছিলেন, আমার জীবনবৃত্তান্ত তারা রেকর্ড করে রাখবেন। তাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিনি। কিন্তু দু’জনের অবিচুয়ারি আমাকেই লিখতে হলো। ভাগ্যের কী পরিহাস।
সৈয়দ আশরাফের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আমার যুবা বয়স থেকেই চিনতাম। আওয়ামী লীগের একজন নেতা, আইনজীবী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। আগে ছিলেন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক। তার ছেলেদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। পরে লন্ডনে এসে পরিচয় তার এক ভাইয়ের সঙ্গে। লেখক ও কিছুটা দার্শনিক। ইংরেজিতে লেখা তার একটা বই বিদেশের পাঠক মহলেও সাড়া জাগিয়েছে। ব্রিটেনের অন্য একটি শহরে তার এক বিবাহিত বোন বসবাস করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন সপরিবারে লন্ডনে বসবাস করছি এবং জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত রয়েছি, সম্ভবত ১৯৭৬ সালের কোনো এক সময় সৈয়দ আশরাফ আমার বাসায় এসে হাজির। তিনি ছিমছাম চেহারার সুদর্শন তরুণ। আমি জানতাম, তার পিতা সৈয়দ নজরুল পুত্রকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আশরাফ থাকতেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের বাসায়। আমাকে জানালেন, জেলে তার পিতাকেসহ চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জহুরুল ইসলামের মনোভাব পাল্টে গেছে। ওই বাসায় তার থাকা আর সম্ভব নয়।
ভেবেছিলাম, একটা ভালো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমার বাসায় তাকে কিছুদিন থাকতে বলব। কিন্তু তার আগেই টুটিংয়ের এক ভদ্রলোকের বাসায় তার সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমরা তখন জিয়াউর রহমানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রবাসে আন্দোলন গড়ে তোলায় ব্যস্ত। আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা গউস খানের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে আমরা সবাই যুক্ত। তার বাইরেও পূর্ব লন্ডনে কিছু তরুণের নেতৃত্বে একটা গ্রুপ গড়ে ওঠে। এদের প্রধান কেন্দ্র ছিল হোয়াইট চ্যাপেলের সাংগ্রিলা রেস্টুরেন্ট। তাদের একজন ডা. জায়েদুল হাসান থাকতেন কমিউনিটি ভবন টয়েনবি হলে। এই ভবনের প্রধান কর্মকর্তা ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু।
সাংগ্রিলা রেস্টুরেন্টভিত্তিক তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন ডা. জায়েদুল হাসান, নূরুদ্দীন আহমদ, ডা. হারিস আলী, সৈয়দ আশরাফ এদের সঙ্গে পরিচিত হন। কিছুদিন পর ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ তাকে টয়েনবি হলে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। এর কিছুদিন পর আশরাফ পূর্ব লন্ডনেরই মন্টিফিয়োরি সেন্টারে কমিউনিটি সংস্থায় চাকরি পেয়ে যান। আশরাফ, ডা. জায়েদ, নূরুদ্দীন ও ডা. হারিস আলী সক্রিয়ভাবে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। প্রথমে বাকশাল সংগ্রাম পরিষদ, পরে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে এরা তার সঙ্গেও যুক্ত হন। শেখ হাসিনা এদের নাম দিয়েছিলেন ‘গ্যাঙ অব ফোর’।
১৯৭৮ সাল থেকে শক্তিশালী বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ব্রিটেনে গড়ে ওঠে। নতুন বাংলাদেশি প্রজন্মের তরুণরা ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারায় অংশ নেয়। তারা শিক্ষা আন্দোলন ও ইকুয়ালিটি বা সব বর্ণের নাগরিকদের সমান অধিকারের আন্দোলনেও নেতৃত্বদানের পর্যায়ে উঠে আসে। আশরাফ ও তার বন্ধুরা এই আন্দোলনগুলোরও পুরোভাগে ছিলেন। আশির দশকের সূচনা ছিল ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির নবজাগরণের যুগ। সৈয়দ আশরাফও ছিলেন এ যুগের বাংলাদেশি তরুণ অগ্রনায়কদের একজন। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের দিকে। তিনি তার কোনো কোনো বন্ধুর মতো ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারায় যোগ দেওয়াকে গুরুত্ব দেননি। প্রায়ই আমাকে বলতেন, তিনি দেশে ফিরে গিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যোগ দিতে চান। তিনি তাই করেছিলেন।
আশির দশকের গোড়ায় বিলাতের বাংলাদেশি নারীদের মধ্যেও নবজাগরণের সূচনা হয়। হোয়াইট চ্যাপেলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাগো নারী’ সংস্থা। এই সংস্থায় বাংলাদেশিদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের নারীরাও জড়িত ছিলেন। এই সংস্থার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি পলা উদ্দীন এখন হাউস অব লর্ডসের সদস্য। এই জাগো নারীর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন শীলা ঠাকুর নামে এক বিদুষী এবং সুন্দরী গুজরাটি তরুণী। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বিস্মিত হয়ে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতা তিনি গড়গড় করে আবৃত্তি করতে পারেন। আশরাফের সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেম এবং শেষ পর্যন্ত পরিণয়। তাদের একটি মেয়ে আছে। শীলা ঠাকুরও ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে একই ক্যান্সারে মারা যান। এই মৃত্যুতে আশরাফ ভেঙে পড়েছিলেন।
শেখ হাসিনা সৈয়দ আশরাফের মধ্যে সুপ্ত রাজনৈতিক মেধা ঠিকই চিনেছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি তাকে নমিনেশন দেন। নির্বাচনে আশরাফ জয়ী হলে তাকে প্রথমে প্রতিমন্ত্রী এবং পরে পূর্ণ মন্ত্রী করেন। তার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে ছিলেন মন্ত্রী, তারপর উপ-রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। পুত্র সৈয়দ আশরাফ হাসিনা সরকারের শুধু একাধিক দপ্তরের মন্ত্রী হননি, আওয়ামী লীগের মতো বিশাল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করতে হয়েছে তাকে।
সৈয়দ আশরাফ মন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনে কতটা সাফল্য অর্জন করেছেন, সে বিতর্কে যাব না; কিন্তু তার বিরুদ্ধে আত্মীয়-তোষণ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কখনও তার সমালোচনাকারীদের মুখেও শোনা যায়নি। এটা একটা বিরল দৃষ্টান্ত। বহু রাজনৈতিক ডিলে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন, যেগুলোতে তিনি বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন। তার রাজনৈতিক লয়ালিটি ছিল প্রশ্নাতীত। শেখ হাসিনা একবার তাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরালেও তার রাজনৈতিক আনুগত্যে কখনও চিড় ধরেনি।
তার সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে মতানৈক্য হয়েছে। রাজনৈতিক মতানৈক্য। তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। তার অকালমৃত্যুতে শেখ হাসিনা একজন নিষ্ঠ সহকর্মী হারালেন। আর দেশ হারাল এক সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতা। এই ক্ষতি সহজে পূর্ণ হবে না। তার শোকগ্রস্ত স্বজন-পরিজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই।