সুনীল বড়ুয়া:
প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার নিয়ে রামু এখন হয়ে ওঠেছে আরো বেশি দর্শনীয় স্থান। তাই কক্সবাজারের পাশাপাশি এখন রামতেও বেড়েছে পর্যটকদের ভীড়। সমুদ্র দর্শসে আসা পর্যটকেরা ভ্রমনে বৈচিত্রতা পেতে ছুঠে আসছেন রামুতে।
রামু যেতে হলে কক্সবাজার আসার পথে রামু বাইপাসে আপনাকে নামতে হবে। আবার কক্সবাজার থেকেও মিনিবাস,সিএনজি অটো রিকসা,ব্যাটারী চালিত টমটমে করে যখন তখন রামু আসা যায়। তবে থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল ও সরকারি ডাকবাংলোও আছে। পর্যাপ্ত হোটেল মোটেল বা গেষ্ট হাউস এখনো রামুতে গড়ে ওঠেনি। তবে ভাল হয় কক্সবাজারের কোথাও থাকলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রামুতে দেখার মত আছে কী কী ? রামুর পোড়া মাটিতে আধুনিক স্থাপত্য শিল্প- ইতিহাস প্রসিদ্ধ রামুতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেবর কাল রাতে ঘটে গেছে এক অবিশ্বাস্য ধ্বংসযজ্ঞ। যে ধ্বংসযজ্ঞে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রামুর প্রাচীন ইতিহাসের স্বাক্ষী এরকম বারটি নিদর্শন। পুড়ে গেছে মহা মূল্যবান বুদ্ধের ধাতু,তাল পাতার উপর বিভিন্ন ভাষায় লেখা ত্রিপিটক, অনেকগুলো বুদ্ধমূর্তিসহ প্রাচীন প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন। পাশাপাশি ওই একরাতেই পুড়েছে এখানকার হাজার বছরের গর্বের ধন-সম্প্রীতি।
তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাত্র এক বছরে বদলে গেছে রামুর দৃশ্যপট। সেই ধ্বংস স্থুপের উপর গড়ে তোলা হয় দৃষ্ঠি নন্দন বৌদ্ধ বিহার। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী নব নিমির্ত সেই বিহারগুলোই এখন নতুন ইতিহাস। একদিন এ ইতিহাসের বয়সও হবে হাজার বছর। রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার,উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র,রামু মৈত্রী বিহার,লাল চিং,সাদা চিং,অপর্ণাচরণ চিং,জাদী পাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার,উখিয়াঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার,উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার,চাকমারকুল অজান্তা বৌদ্ধ বিহারসহ নব নির্মিত এসব বৌদ্ধ বিহার যেন এখন নতুন ইতিহাস। এসব বিহারের ঐতিহ্য নিয়ে আবার নতুন করে সমৃদ্ধ এই রামু।
নব নির্মিত এসব বৌদ্ধ বিহার তো আছেই পাশাপাশি প্রাচীন এমন কয়েকটি পুরাকীর্তি আছে যেগুলো দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। অন্য রকম আলোয় আলোকিত বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র উচু নীচু পাহাড় টিলায় সবুজের সমারোহ। এ সবুজের মাঝে গড়ে ওঠেছে মানুষের বসতি। শান্ত কোমল পরিবেশে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মানুষকে অবিরাম কাছে টানার মত জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের উত্তর মিঠাছড়ি গ্রাম। সেই অসাধারণ সৌন্দর্য্যে ঘেরা পাহাড় চূড়ায় এক টুকরো সবুজের মাঝে ছিল বাঁশের তৈরী বিমুক্তি বির্দশন ভাবনা কেন্দ্র। এর সামনেই ছিল উত্তর-দক্ষিন কাত হয়ে শোয়া গৌতম বুদ্ধ মূর্তি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিহারটি সম্পুর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও মূর্তিটি প্রায় অক্ষত থেকে যায়। অন্যান্য বিহারগুলোর মত এটিও নতুন ভাবে নির্মাণ করে সেনাবাহিনী। তবে সেনাবাহিনী বারটি বিহার নির্মাণ করলেও সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ রূপ পেয়েছে এ বিহারটি। বর্তমানে যে কেউ বিহারটি দেখে অভিভূত হবেনই। বিহারের চমৎকার নির্মাণ শৈলী তো আছেই এ ছাড়াও বিহারের আঙ্গিনাকেও সাজানো দারুনভাবে। সেই অসাধারণ সৌন্দর্য্যের মাঝে নতুনভাবে শোভা পাচ্ছে একশ ফুট দীর্ঘ বিশালাকার আগের সেই মূর্তিটি। বর্তমানে এটি যেন সাধারণের চেয়েও বেশি অসাধারণ । বলা যায়,রামুর বৌদ্ধ ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র। পাশাপাশি এটিই এখন পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান।
রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার চৌমুহনী স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে, রাজারকুল এলাকায় পাহাড় চূড়ায় মন্দিরটি অবস্থিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ৩০৮ খ্রীষ্টপূর্বে সম্্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেন । প্রবেশ পথের দু’ধারে সারি সারি ঝাউবাথি আর সাজানো গুছানো বাগান দেখে আপনার মন পূলকিত হবেই। সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠেই দেখবেন বড় বড় দুটি বূদ্ধমূর্তি। বৌদ্ধদের মতে, এর একটিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি স্থাপিত হয়েছে। আশে পাশে ঘুরলে আরও অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে পাবেন এখানে।
বৌদ্ধদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান এটি। লামার পাহাড় ক্যাং লামার পাড়ায় এ ক্যাংটি অবস্থিত বলে এর নাম লামার পাড়া ক্যাং। অনেকে থোয়াইংগ্যা চৌধুরীর ক্যাং ও বলে থাকেন। ১৮০০ সালে তৎকালীন রাখাইন জমিদার উথোয়েন অংক্য রাখাইন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পাড়ার ভেতরের শান্ত নিথর কিছুটা পথ মাড়িয়ে এ ক্যাং পৌছবেন। দেখে আশ্চর্য হবেন, এত বড় বড় পিতলের ঘন্টা, এত বড় বুদ্ধমূর্তি এভাবে পড়ে আছে! অষ্টধাতু নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি এটি। আর ওই রকম অনেকগুলো পিতলের ঘন্টা চুরিও হয়ে গেছে। হয়তো ভাববেন, প্রাচীন এসব পূরাকীর্তি সংরক্ষণে সরকারের কেন এত অবহেলা?
পাকা মসজিদ উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের সবুজ পাহাড় ঘেরা উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামে ১৮৬২ সালে ওই এলাকার জমিদার প্রয়াত আলী হোসেন চৌধুরী প্রকাশ কালা চাঁন্দ চৌধুরী প্রায় বিশ শতক জমির উপর এই মসজিদটি নির্মান করেন। এক কথায় এ মসজিদের নির্মান শৈলী দারুন, চমৎকার। মসজিদের উপরে ঠিক মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ, দুই পাশে দুটি মাঝারি আকৃতির গম্বুজসহ ছোট বড় বারটি মিনার রয়েছে। পাকা সীমানা প্রাচীরে ঘেরা এ মসজিদের মূল ফটকের ঠিক উপরে তৈরী করা হয়েছে আযানখানা। প্রায় দেড়শ বছর পুরনো এই মসজিদে এক সাথে চারশ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে বর্তমানে সংস্কার ও উপযুক্ত রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে এটি অনেকটা শ্রীহিন অবস্থায় পড়ে আছে।
ঐতিহাসিক রামকোট তীর্থধাম হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক নিদর্শন রামকোট তীর্থধাম। কথিত আছে, রাম চন্দ্র দেব সপ্তম অবতারে পিতৃ সত্য পালনে চৌদ্দ বছরের জন্য যখন বনবাসী হয়ে ছিলেন, তখন বন-বনান্তরে ঘুরতে ঘুরতে পঞ্চবটি বনে একটি কুটির স্থাপন করেন। ধারনা করা হচ্ছে, সেই কুটিরই হচ্ছে রামকোট তীর্থধাম। জনশ্রুতি আছে এখানে শীতার মরিচ বাটার পাটা আছে। হিন্দু শাস্ত্র মতে সকল তীর্থ ভ্রমনের পর রামুর রামকোট তীর্থধামে সংরক্ষিত শিব দর্শনেই সকল পূণ্যের পুর্ণতা লাভ হয়।
চেরাংঘাটা বড় ক্যাং- এ ক্যাংটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে সিদ্ধ করা বিশাল আকৃতির কাঠ। সব কাঠই রেঙ্গুন থেকে আনা। রেঙ্গুনী কারুকাজ আর ক্যাং এর অভ্রভেদীচূড়া, সামনের গুছানো ফুলের বাগান সত্যিই আপনাকে মুগ্ধ করবে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে যেতে দেখবেন দুটি সাদা সিংহ দরজার দুই পাশে বসে আছে। ভয় পাবেন না, ও গুলো শ্বেত পাথরের। উপরে ওঠেই দেখবেন আলো আধাঁরি পরিবেশ আর সেখানে অপূর্ব কারুকাজে খচিত অনেকগুলো বুদ্ধের আসন আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। প্রতিটি আসনে বসানো আছে মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি। খুব সম্ভবত ছোট বড় ২২ টি মূর্তি আছে এখানে। এর মধ্যে ছয় ফুট লম্বা কাঠের সিংহ শয্যা বুদ্ধমূর্তি, সেকালের বড় বড় ১১টি দেয়াল ঘড়ি, তালপাতার উপর পালি ভাষায় লেখা ত্রিপিটক, বুদ্ধের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চিত্রপট, ত্রিপিটক লাইব্রেরীসহ আরো আছে অনেক কিছু। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারবেন না। কিন্তু ওখানেই লেখা আছে, ‘ছবি তোলা নিষিদ্ধ’ ।
এসব দর্শনীয়স্থান ছাড়াও আপনার ভ্রমনের তালিকায় যোগ হতে পারে দেশের বৃহত্তম রামু রাবার বাগান,পাহাড় চুড়ায় নির্মিত চাতোফা চৈত্য,রামু নারকেল বীজ বাগান ও হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্রসহ অন্তত আরো পনেরটি বৌদ্ধ বিহার। তবে সবগুরো দেখতে হলে আপনার হাতে অন্তত পুরো একটা দিন সময় রাখতে হবে। আবার কক্সবাজার ফিরেও আপনার হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র দেখার সুযোগ থাকছে। দর্শনীয় এই স্থানটি রামুতে পড়লেও আপনাকে হিমছড়ি যেতে হবে কক্সবাজার হয়ে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশ ঘেষে হিমছড়ি যেন রামুর নিম্নাংশ, যেন পা। বিশাল বঙ্গোপসাগরের দূরন্ত ঢেউয়ের দোলায় দোলায়িত লোনা জলের গভীরে যেন পা ডুবিয়ে আছে রামু।
সমুদ্রের পা ঘেষে আছে ঝাউবন আর সবুজ পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে সুন্দরী ঝরণা। বালুচরে ঝিনুক আর লাল কাঁকড়ার আঁকা নকশা দেখে মনে হবে এ যেন শিল্পীর হাতের অসাধারণ শিল্প চিত্র। অদ্ভূত এক সৌন্দর্য্য সুষমায় মন্ডিত এই হিমছড়ি । সব মিলিয়ে অসাধারণ ভারী হবে আপনার ভ্রমনের ঝুলি।