অনলাইন ডেস্কঃ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, লাশকাটা ঘর ও পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা- এই তিন এলাকায় গতকাল শুক্রবারও ছিল গভীর শোকে কাতর স্বজনের ভিড়। কেউ এখনও খুঁজে ফিরছেন তার স্বজনের অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহখানি। ছোট্ট শিশু খুঁজছে মাকে, ভাই খুঁজছে বোনকে। দেখা গেল স্ত্রীর লাশের সন্ধান পেতে স্বামীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। তাদের একেকজনের একেকটি মর্মন্তুদ গল্প। পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘড়ি, গহনা বা দীর্ঘদিনের চেনা শরীরও যখন পরিচয় শনাক্তে যথেষ্ট হয়নি, তখন কেউ কেউ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্তের জন্য নমুনা দেন।
প্রিয় মানুষের দেহখানি সত্যি তারা শনাক্ত করতে পারবেন কি-না, তা তাদের জানা নেই। অশ্রুসিক্ত চোখে কোনো কোনো স্বজন গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে স্মৃতির জানালা খুলে দিচ্ছিলেন। আবার কারও বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছিল পরিবেশ। চকবাজারের ভয়াবহ আগুন যে ৬৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তারা তো আর ফিরবেন না। তবে এমন কান্নার শেষ কোথায়- এই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। কারণ কোনো একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কিছু দিন আলোচনা-সমালোচনা চলে। কেউ দায় এড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সময়ের তালে তালে তার রেশও একসময় ফুরিয়ে যায়। তখন সবাই ভুলে যান আগের শোকগাথা। পুরনো ঘটনা থেকে যেন কেউ শিক্ষা নিতে চান না।
জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মে। এরপর ঘটে আরেকটি দুর্ঘটনা। যার সর্বশেষ নজির চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি।
গতকাল চুড়িহাট্টার ধ্বংসস্তূপ ধুয়েমুছে সাফ করার চেষ্টা চলছিল। পুড়ে যাওয়া যানবাহন ও বাসার আসবাব সরাচ্ছিলেন কেউ কেউ। নতুনভাবে ঘর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক করে নেওয়ার কাজও চলছিল। তবে প্রশ্ন হলো- এমন আরেকটি ট্র্যাজেডি রোধে কতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে? আবার কি একই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে হবে? জনবসতিপূর্ণ কোলাহলময় পুরান ঢাকা থেকে কবে সরানো হবে কেমিক্যালের গুদাম। সেখানে প্রায় সব বাড়িতে কোনো না কোনোভাবে কেমিক্যালের গোডাউন ও কারখানা রয়েছে। এমনকি চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামে যে বাড়ির সামনে থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই বাড়ির প্রায় পুরোটা ছিল কার্যত কেমিক্যাল নামক ‘বোমা’র গুদাম। ওয়াহেদ ম্যানশনের ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রসাধনী ব্র্যান্ড ‘ক্লেরিসে’র বেবি লোশন ও দুবাইয়ের ‘স্টারলিং’ পারফিউমের শত শত বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। দেশে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন হয় না। বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নকল মোড়কের এসব পণ্য ওয়াহেদ ম্যানশনের ভাড়া গুদামে রেখে তা বাজারজাত করা হচ্ছিল।
নয় বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডিতে প্রাণ যায় ১২৪ জনের। তার পর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত পদক্ষেপের কোনো কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি। তাই পুরান ঢাকায় যেন আরেকটি বড় ট্র্যাজেডির ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। চকবাজারের ভয়াবহ দুর্ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। এ ঘটনায় বিশ্ব গণমাধ্যমে আবারও শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাে র পর সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে জন্য কাজ করছে সরকার। পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনার উৎস ও কারণ অনুসন্ধানে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, চকবাজার এলাকায় অগ্নিকাে সরকারি কোনো সংস্থার অবহেলা আছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হবে। গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী এ কথা বলেন।
চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটির একজন সদস্যও।
জুলফিকার রহমান বলেন, ভবনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। বোতলে পারফিউম রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলের পারফিউম বাষ্প হয়ে ‘বোমা’র মতো কাজ করেছে।
মামলা :
চকবাজারে অগ্নিকাে হতাহতের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত প্রাণনাশ’ অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। আগুনে জীবন্ত দগ্ধ আরাফাত ইসলাম সিয়ামের (১৯) স্বজন হাবীবুর রহমান রুবেল শুক্রবার চকবাজার থানায় এ মামলা করেন। পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান জানান, মামলায় চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাজি প্রয়াত আবদুল ওয়াহেদের দুই ছেলে সোহেল ও হাসানসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
৪৬ জনের লাশ হস্তান্তর :
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত অগ্নিকাে নিহতদের মধ্যে ৪৬ জনের পরিচয় শনাক্তের পর তাদের মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বজনের কাছে। তাদের মধ্যে অনেককে আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এখন পর্যন্ত ২১ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। লাশ শনাক্ত করতে নিহতদের স্বজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন টিম নমুনা সংগ্রহ করছে। গতকাল নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নমুনা দিতে আসেন। এখন পর্যন্ত ১৮টি মৃতদেহের জন্য ৩০ স্বজন এসে তাদের ডিএনএ নমুনা দিয়ে গেছেন। সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন বলেন, নিয়মিত মৃতদেহের নমুনা দিয়ে শনাক্ত করা হলেও অগ্নিদগ্ধদের ক্ষেত্রে তা সময়সাপেক্ষ। যারা ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন, তাদের রক্ত ও মুখের ভেতর থেকে কোষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। মৃতদেহ থেকে হাড় ও দাঁতের নমুনা নেওয়া হয়েছে। মৃতদেহ শনাক্ত করতে এক থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে। আজ শনিবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বুথ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এরপর সিআইডিতে যোগাযোগ করতে হবে। মৃতদেহের নমুনা দেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবা বা স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানকে আসার অনুরোধ করেছেন সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট। তাদের পাওয়া না গেলে ভাইবোন আসতে পারেন।
ঢামেক মর্গের সামনে স্থাপিত জেলা প্রশাসকের তথ্যকেন্দ্র জানায়, চারজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে, ১৫ জনের লাশ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে, তিনজনের লাশ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে রাখা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ৯ জন। তাদের সবার অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন।
চুড়িহাট্টায় শোক ও ক্ষোভ :
শুক্রবার সরেজমিন চুরিহাট্টায় দেখা যায়, পুরো এলাকায় উৎসুক জনতার ভিড়। শোকের আবহের মধ্যে অনেকের কণ্ঠে ছিল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এলাকার আবদুল আলী বললেন, ‘যতদিন বাসার নিচে ও আশপাশে কেমিক্যালের মতো বোমা নিয়ে ঘুমাব, ততদিন আমাদের কপালে এমন ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা থাকবে। আমাদের নিজেদের আগে বদলাতে হবে। এনামুল হক নামে আরেকজন বললেন, পুরান ঢাকাবাসীকে দুর্নাম না দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া প্রতিবেশীদের জন্য শোক এখনও কাটেনি চুড়িহাট্টায়। ঘটনাস্থলের অদূরে চুড়িহাট্টা শাহি মসজিদে জুমার নামাজের পর মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসল্লিরা। এ সময় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমসহ চুড়িহাট্টাবাসী নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। নামাজ শুরুর আগে হাজী সেলিম মুখপাত্রের মাধ্যমে এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমার আদেশ ও অনুরোধ, আপনারা কেউ নিজের বাসায় কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দেবেন না।’
বোনকে খুঁজছেন ভাই :
নিখোঁজ তরুণীর নাম ফাতেমা তুজ জোহরা (২১)। তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বুধবার শিল্পকলা একাডেমিতে কবিতা আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠান শেষে লালবাগের পোস্তায় বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তবে আর ফেরেননি। সেও কি চকবাজারের আগুনে নিভে গেছে- এমন আশঙ্কায় শুক্রবার আদরের ছোট বোনের নাম নিখোঁজের তালিকায় লিখিয়েছেন তার ভাই সাইদুল ইসলাম সানি।
তিনি বলেন, বুধবার ফাতেমার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন সে মৎস্য ভবনের কাছাকাছি ছিল। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। লালবাগ থানায় জিডি করা হয়। তার খোঁজ পেতে ডিবি ও র্যাবের সহায়তা চেয়েছি। সানি বলেন, র্যাব-ডিবি তদন্ত করে দেখেছে, ১০টা ১৬ মিনিটে ফাতেমার ফোনের লোকেশন ছিল বেগম বাজারে। এ তথ্য জানার পর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে যাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে আহতদের তালিকায় নাম পাইনি। তিনি আরও বলেন, বোনের লাশটা শনাক্ত করতে পারলেও এক ধরনের সান্ত্বনা পেতাম।
সানির মতো এমন কষ্টে আছেন অনেক মানুষ। সবার একই চাওয়া- ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। অকালে যেন কাউকে প্রাণ হারাতে না হয়।
রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের শোক :রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বহু লোকের প্রাণহানিতে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। গতকাল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক বার্তায় পুতিন বলেন, নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি এবং একই সঙ্গে এই দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
এদিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার চকবাজার ট্র্যাজেডিতে গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো বার্তায় বলেছেন, এই কঠিন সময়ে আমরা বাংলাদেশের জনগণ ও দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের জন্য চিন্তিত এবং তাদের জন্য প্রার্থনা করছি।
এদিকে, গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপো চকবাজারের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের আলোক প্রজ্বালন :
বৃহস্পতিবার চকবাজার ট্র্যাজেডিতে শোকাহত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা। নিহতদের স্মরণে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় বাংলাদেশিরা আলোক প্রজ্বালনের মাধ্যমে স্বজন হারানো পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করেন।
সূত্রঃ সমকাল