অনলাইন ডেস্কঃ
বিশ্বের সব বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় যাত্রীদের সুরক্ষার বিষয়টিই সর্বাধিক প্রাধান্য পায়। যে কারণে বিমান ছিনতাই ইতিহাসে ছিনতাইকারীর দাবি মেনে নেওয়ার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু গত রোববার বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী ছিনতাই প্রচেষ্টায় বিমানের ক্যাপ্টেন গোলাম শফি, ক্রু এবং সেনা কমান্ডোদের ব্যতিক্রমী সাফল্য হচ্ছে ছিনতাইকারীর কাছে নতিস্বীকার না করেই সব যাত্রীকে নিরাপদে উড়োজাহাজ থেকে বের করে আনা। এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল সমকালকে বলেন, ময়ূরপঙ্খীর ওই দিনের পাইলট ক্যাপ্টেন গোলাম শফি, সহকারী ক্যাপ্টেন মুনতাসীর মাহবুব, ক্রু মিম্মি, হোসনে আরা, রুমা, সাগর, শাকুর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মূলত ছিনতাই প্রচেষ্টা প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই সাহসিকতার জন্য তাদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
বিমান ছিনতাই এবং ছিনতাই প্রচেষ্টার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ধরনের মুহূর্তে পাইলটের ভুল কিংবা সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে বিমান বিধ্বস্ত হওয়াসহ ছিনতাইকারীদের দাবির কাছে কর্তৃপক্ষের নতিস্বীকারের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ময়ূরপঙ্খীর ক্ষেত্রে পাইলট এবং তার সহকারীদের দক্ষতাই বড় বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করেছে।
বিমান ছিনতাই ইতিহাস ও ময়ূরপঙ্খীর ঘটনা :বিশ্বে আলোচিত বিমান ছিনতাই কিংবা ছিনতাই প্রচেষ্টার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল উদ্ধারের ঘটনা রোববারের ময়ূরপঙ্খীর সফল অপারেশন। ইতিহাসের ঘটনা পর্যালোচনায় এটাই প্রমাণিত হয়।
বিশ্বের আলোচিত বিমান ছিনতাই ঘটনার মধ্যে প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৪৮ সালের ১৬ জুলাই। ওই দিন চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ম্যাকাও থেকে হংকং যাওয়ার পথে ‘ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারওয়েজ’-এর ‘ক্যাটেসিনা’ নামে একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে ম্যাকাও সাগরে বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজের ২৬ যাত্রীর মধ্যে একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। পরে তদন্তে দেখা যায় বেঁচে যাওয়া সেই যাত্রী ওয়ং উ ম্যানই ছিল ছিনতাইকারী দলের নেতা। বিমানটি আকাশে ওড়ার পর তার নেতৃত্বে চারজন যাত্রীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবির কথা জানায় পাইলটকে। এ সময় পাইলট বাধা দিতে এলে ছিনতাইকারীরা তাকে গুলী করে। এরপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিমানটি ম্যাকাও সাগরে বিধ্বস্ত হয়।
দ্বিতীয় আলোচিত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। এ ঘটনা ছিনতাইকারী ডিবি কুপারকে সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরাক্রমশালী এফবিআইয়ের ইতিহাসে বৃহত্তম ব্যর্থতার ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ঘটনার দিন যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ড শহর থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে একটি ফ্লাইট যাত্রা শুরুর পর ডিবি কুপার অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে দুই কোটি ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। পরে উড়োজাহাজ জরুরি অবতরণ করিয়ে দুই কোটি ডলার নিয়ে আবারও পাইলটকে উড়তে বাধ্য করে এবং মধ্যাকাশ থেকে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডিবি কুপার। পরবর্তী সময়ে তদন্তে এফবিআই জানতে পারে ডিবি কুপার নিরাপদে মাটিতে নামতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৪৭ বছরেও ডিবি কুপারের কোনো সন্ধান বের করতে পারেনি এফবিআই। এ কারণে ডিবি কুপারকে বলা হয় ইতিহাসের রহস্যময় মানব। একইসঙ্গে এফবিআইয়ের ইতিহাসেও ডিবি কুপারকে খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাকে সবচেয়ে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়।
১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতিহাসের অপর আলোচিত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার বিমানবন্দরের নামটিও। জাপান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ ১৫৬ যাত্রী নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে জাপানের টোকিও যাওয়ার পথে ভারতের মুম্বাইতে যাত্রাবিরতি করে। বিরতির পর উড্ডয়ন করতেই জাপানের উগ্র বামপন্থি সংগঠন ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’র সদস্যরা বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রী, পাইলটসহ ক্রুদের জিম্মি করে ঢাকায় অবতরণ করে। এরপর জাপানি কর্তৃপক্ষের কাছে ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি এবং জাপানে আটক সংগঠনের অন্য নেতাদের মুক্তির দাবি করে। জাপান কর্র্তৃপক্ষ ছিনতাইকারীদের দাবি মেনে নিয়ে অন্য একটি উড়োজাহাজে অর্থ পাঠিয়ে দিলে ঢাকায় ১১৮ যাত্রীকে মুক্তি দিয়ে বাকি যাত্রীদের নিয়ে ছিনতাইকারীরা সিরিয়ার দামেস্কে যায়। সেখানে আরও ১১ যাত্রীকে মুক্তি দিয়ে চলে যায় আলজেরিয়ায়। এরপর ছিনতাইকারীরা বাকিদের মুক্তি দিয়ে নিজেরাও পালিয়ে যায়। তবে উড়োজাহাজটি আলজেরিয়া কর্তৃপক্ষ বাজেয়াপ্ত করে।
এ ধরনের আরও ঘটনা আছে ইতিহাসে। ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলি বিমান ছিনতাই, ১৯৮৫ সালে মিসরীয় বিমান ছিনতাই যেখানে উদ্ধার প্রচেষ্টার সময় এক ছিনতাইকারীসহ ৬০ যাত্রী নিহত হন। ১৯৭০ সালে একযোগে চারটি ব্রিটিশ এবং সুইস বিমান ছিনতাই করে ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির জন্য গড়ে ওঠা পপুলার ফ্রন্ট। ১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, ১৯৮৬ সালে ইরাকি এয়ারলাইন্স, ১৯৯৬ সালে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ওপরের এসব ঘটনাসহ অতীতে বিমান ছিনতাইয়ের প্রতিটিতেই পাইলট ছিনতাইকারীদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন। এবারই প্রথম ময়ূরপঙ্খীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল, যেখানে পাইলট এবং তার সহকারীরাই ছিনতাইকারীকে ব্যর্থ করে দিয়ে নিরাপদে অবতরণ এবং যাত্রীদের বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মইনউদ্দীন খান বাদলের চোখে পাইলট শফি :ক্যাপ্টেন গোলাম শফি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যই তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি মইনউদ্দীন খান বাদল ঘটনার দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে শাহ আমানত বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, অনেকে তাকে ওই ফ্লাইটের যাত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এটা ভুল। তিনি ঘটনার সময় শাহ আমানতে ছিলেন এবং ঘটনা জেনে টারমাক পর্যন্ত গিয়ে যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে আনার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন।
এ সময় তিনি যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এটা সুস্পষ্ট যে ক্যাপ্টেন গোলাম শফির উপস্থিত বুদ্ধি এবং তার নেতৃত্বে সহকারী পাইলট ও ক্রুদের সাহসিকতার জন্যই বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে। তিনি আরও বলেন, ক্যাপ্টেন ককপিট নিরাপদ রেখে ক্রুদের মাধ্যমে ছিনতাই প্রচেষ্টায় থাকা যুবকের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি তাকে নাশকতা এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত রাখেন এবং বিমানটি শাহ আমানতে নিরাপদে অবতরণ করান। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে ছিনতাইকারীকে কৌশলে নিবৃত্ত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতের প্রায় সব ঘটনায় পাইলটরা ঘটনার আকস্মিকতায় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি। কিন্তু গোলাম শফি দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সবাইকে রক্ষা করেছেন। এ জন্যই তার এবং তার সহকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
সূত্রঃ সমকাল