রাশেদ মেহেদীঃ
একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে নানা বেসরকারি প্রচেষ্টা আছে। তবে নেই জোরালো সরকারি কূটনৈতিক উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ এর আগে হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন খোলা আছে শুধু একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথ। তবে এ ক্ষেত্রেও জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে পাকিস্তান এখনও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ কিংবা ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে প্রচার করে এই গণহত্যা ও ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকে বিকৃত ও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিললে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলে এ-সংক্রান্ত ইতিহাস ও এর হন্তারক রাষ্ট্র, সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্পর্কেও নানা তথ্যের উল্লেখ থাকবে। ইতিহাসের দায় এড়াতে পাকিস্তানও তাই নানাভাবে এ স্বীকৃতি আদায়ের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে এবং নানা অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানাচ্ছে, আঞ্চলিক এবং বিশ্বরাজনীতির সাম্প্রতিক কৌশলগত অবস্থান, সম্পর্ক ও মিথস্ট্ক্রিয়ার কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এই গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব তুললে পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো রাষ্ট্রও বাংলাদেশের প্রস্তাবের বিপক্ষে যেতে পারে। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সঙ্গে না এগোলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এ কারণে সতর্কতার সঙ্গে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগোতে হচ্ছে।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে জানান, একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে সরকারি পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তা বিবেচনায় রেখেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সমকালকে বলেন, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে প্রথমে জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে হয়। এর পর আরও অনেক ধাপ পেরিয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করতে হয়। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে, তাও বলা সম্ভব নয়। তবে এটা সত্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বসে নেই, যতভাবে প্রচেষ্টা চালানো সম্ভব, মন্ত্রণালয় তা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বীকৃতির জন্য যত উদ্যোগ:
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সমকালকে জানান, একাত্তরের গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ সরকারি পর্যায় থেকে সত্যিকার অর্থে কখনও নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য ২০০৫ সালে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে কথা হয় ইউনেস্কোর। ২০০৭ সালে নির্মূল কমিটি থেকে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দিয়ে ইউনেস্কোর কাছে চিঠি লেখা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব সরকারিভাবে যেতে হয় বলে বেসরকারি এ প্রস্তাবে কোনো কাজ হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায় থেকে কোনো প্রস্তাব জাতিসংঘে ২০১৫ সাল পর্যন্তও যায়নি।
শাহরিয়ার কবির জানান, এরই মধ্যে আর্মেনিয়া সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে অন্য একটি তারিখে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয় না জানার পর ২০১৫ সালে আর্মেনিয়া এই যুক্তি তুলে ধরে যে, ওই রাষ্ট্রেই যখন দিনটি জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃত নয়, তখন তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়া হয় কীভাবে? সে বছরই আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশও এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
শাহরিয়ার কবির জানান, ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে এ প্রস্তাবে বলা হলো, ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা চালানো হবে, যা ছিল কৌশলগত ভুল। কারণ দু’বছর আগে জাতিসংঘে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের পক্ষে ভোট দেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কীভাবে আবারও এই স্বীকৃতির প্রস্তাব নেয়, তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, প্রস্তাব করা উচিত ছিল ‘একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালানো হবে।’
এ ব্যাপারে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান সমকালকে বলেন, ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ আর নেই। এখন এ দিবসকে ‘যুদ্ধ ও নিষ্ঠুরতাবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব দিলে তাতে প্রথমত, একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাইতে হবে। দ্বিতীয়ত, ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও নিষ্ঠুরতাবিরোধী দিবস’ ঘোষণার দাবি জানাতে হবে।
ডা. এম এ হাসান জানান, গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য এর বিস্তারিত বিবরণ যেমন তুলে ধরতে হয়, তেমনি ফরেনসিক প্রমাণও জোগাড় করতে হয়। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি প্রায় দুই যুগ আগে থেকেই একাত্তরের গণহত্যার বিষয়ে ফরেনসিক প্রমাণ জোগাড়ের কাজ শুরু করে। একাত্তরের বিভিন্ন গণহত্যার বিস্তৃত বর্ণনা, তথ্য-উপাত্ত এবং প্রমাণ সংগ্রহের পর এই কমিটির পক্ষ থেকে ‘বিয়ন্ড ডিনায়েল’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বইটি দেওয়া হয়েছে। এ বইটি সরকারিভাবে উন্মুক্ত করা হলে আন্তর্জাতিক মহল একাত্তরের গণহত্যার স্পষ্ট চিত্র পাবে। তিনি বলেন, একাত্তরের গণহত্যার জোরালো তথ্য-উপাত্ত ও ফরেনসিক দলিলসহ নানা প্রমাণ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির কাছে আছে। সরকার চাইলেই কমিটির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
যেখানে আটকে আছে প্রচেষ্টা:
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যেমন, আর্মেনিয়ার গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে লেগেছে প্রায় একশ’ বছর। এ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে বড় বাধা ছিল তুরস্কের বিরোধিতা। কারণ প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তুর্কি সেনাসদস্যদের হাতেই প্রায় ১৫ লাখ আর্মেনীয় নিহত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসের’ স্বীকৃতি পায়। এ সময় তুরস্কসহ তার মিত্র দেশগুলো ভোটদানে বিরত থাকলেও বিপক্ষে ভোট দেয়নি।
এর পর থেকে একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি আরও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। তবে এ নিয়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ এখনও তেমন দানা বেঁধে ওঠেনি। যদিও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বাংলাদেশ নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বিভ্রান্তিও দূর হয়েছে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে যে সব বন্ধুরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে ছিল তাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘বিয়ন্ড ডিনায়েল’-এর কপি অনেক দেশে পাঠানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায় থেকে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে যোগাযোগের প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র একাত্তরের গণহত্যার বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল হয়ে উঠলে বাংলাদেশ কূটনৈতিক উদ্যোগের পথে পা বাড়াবে। অর্থাৎ সমর্থন চেয়ে বিভিন্ন দেশের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেবে। বেশিরভাগ দেশের সমর্থন নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব জাতিসংঘে তুলবে।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক সমকালকে জানান, ২০১৭ সালের পর এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পাঁচটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছে। যেখানে বিদেশি গবেষক, আইন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সামনে একাত্তরের গণহত্যার বিস্তারিত চিত্র ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। সামনে এ ধরনের আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পুরোপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যে অপরাধমূলক কাজ করা হয়, তা-ই গণহত্যা। এ সংজ্ঞা তুলে ধরে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের কনভেনশন বাংলাদেশের পক্ষেই রয়েছে। এখন দরকার শুধু কার্যকর ও দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগের।
সূত্রঃ সমকাল