মুনতাসীর মামুনঃ
প্রত্যেক গণহত্যার একটি রাজনীতি আছে। সে রাজনীতিকে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলা যায়, অজুহাত তৈরি করে গণহত্যার এবং গণহত্যা অস্বীকারের। জার্মানির হিটলার যে শুধু ইহুদিদের হত্যা করেছেন তা তো নয়। ইহুদিদের সঙ্গে প্রগতিশীল, উদার, কমিউনিস্টদেরও হত্যা করেছেন। এ কারণে আর্য শ্রেষ্ঠত্ব তত্ত্ব তৈরি করেছেন এবং ইহুদি হত্যার অজুহাত তৈরি করেছেন। এই ইহুদি হত্যা হলোকাস্ট নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
আর হিটলার এ অজুহাতে ইউরোপ জয় করতে চেয়েছেন। তবে হিটলারের প্রভুত্ব বিস্তারে এটিই একমাত্র কারণ ছিল না।
বাংলাদেশে গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতি ও সুপার পাওয়ারদের ভৌগোলিক বা কৌশলগত স্বার্থ। পাকিস্তানের রাজনীতির বিষয়টি আমাদের জানা। কৌশলগতভাবে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য ছিল পাকিস্তানের মিত্র এবং মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে গণহত্যার সময় পাশ্চাত্য বা আমেরিকার জনমত ছিল গণহত্যার বিপক্ষে এবং তা এত জোরালো ছিল যে, তাদের সরকার কাঠামোয় পাশ্চাত্য বা পরে আমেরিকাকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে।
এ গণহত্যা বিশ্বে উপেক্ষিত হলো এ কারণে যে, গণহত্যার বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপিত হলে বিচারের বিষয়টি উঠে আসে, নৈতিকভাবে তা অস্বীকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এতে সাহায্য করেছে। ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসিত সরকারগুলো মূলত পাকিস্তানের এজেন্ডা পালন করতে চেয়েছে। গণহত্যার চেয়ে বিজয়ের ওপর তারা জোর দিয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হয়েছে জয়ের নায়ক হিসেবে। গণহত্যার বিষয়টি এলে জামায়াতে ইসলামী ও জঙ্গি মৌলবাদীদের প্রতিষ্ঠা করা যায় না, যারা তাদের মিত্র। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, গণহত্যাকারী হিসেবে জামায়াত ও তার সমর্থক বিএনপিকে দায়ী করেছে। ইতিহাসের এ দায় এড়ানো তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ছিল এ রাজনীতির কঠিন সিদ্ধান্ত, যেটি শেখ হাসিনা এককভাবে নিয়েছেন। গণহত্যার বিষয় উঠলেই প্রান্তিক মানুষরা রাজনীতিতে এসে যায়, ৩০ লাখ শহীদ ও পাঁচ লাখের ওপর নির্যাতিতার পরিজনের সমর্থন পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। কারণ, নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থনকারীরা এতে এত সফল হয়েছে যে, অচিরেই বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গি মৌলবাদীদের রাজনীতি লুপ্ত না হলেও বিপন্ন হয়ে উঠবে।
গণহত্যার পটভূমি তখনই তৈরি হয়, যখন শাসক শাসন ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব লাভ করে এবং জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তার সমর্থক হয়ে ওঠে। যখন তিনি কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন তখন তার মনে হয়, তিনি যা করছেন তা জাতি বা রাষ্ট্রের ভালোর জন্যই করছেন এবং দমন করাকে মনে করা হয় শক্তির প্রদর্শন, যা কর্তৃত্ব অটুট রাখবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য সে আশা ফলপ্রসূ হয় না। তবে কৌশলগত কারণে তা অন্য রাষ্ট্রের পক্ষে গেলে তারা নিশ্চুপ থাকে। ইসরায়েলিরা যে গণহত্যা চালাচ্ছে আরবদের ওপর, তাতে পাশ্চাত্যের প্রায় সবাই এমনকি আমেরিকাও নিশ্চুপ। কারণ তা তাদের স্বার্থবিরোধী নয় এবং আরব রাষ্ট্রগুলো যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার, সেহেতু মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা শুধু নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কও তৈরি করেছে। আবার গণহত্যা শব্দটি যেহেতু সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং ঐতিহ্যগতভাবে সবচেয়ে বড় অপরাধকে বোঝায়, সে জন্য নতুন কিছু সংজ্ঞা তৈরি করেছে পাশ্চাত্য, যেমন ‘এথনিক ক্লিনজিং’ ‘ম্যাস মার্ডার’ প্রভৃতি। মিয়ানমারে যখন রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরু হয়, তখন তাকে প্রথমে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলা হয়েছিল, যেন তাতে অপরাধ কমে। কিন্তু চীন ও ভারত যখন এই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ সমর্থন শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র একে গণহত্যা নামে অভিহিত করেছে এবং জাতিসংঘও তাই বলছে। চীন অবশ্য সবসময় নিজ স্বার্থে গণহত্যা সমর্থন করে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে যেহেতু বাংলাদেশ চীন বা ভারত- কারও বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, সেহেতু রোহিঙ্গাদের দায় বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে, যদি না দৈবশক্তি বাংলাদেশের প্রতি পক্ষপাত করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন পাকিস্তান বাহিনী প্রবল গণহত্যা ও নির্যাতন চালায়, তখনও এমনটি ঘটেছিল। আজ প্রায় ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। ভূরাজনীতির পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে এবং গণহত্যা-নির্যাতন সম্পর্কিত অপরাজনীতি আবার আলোচনায় আসছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল, বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। গণহত্যার মধ্যে অন্তর্গত বিভিন্ন মানুষকে অকারণে হত্যা। জাতিগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক বিশ্বাস বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হত্যা। হানাদারদের কারণে মানুষকে বাস্তুত্যাগ করতে হয়েছে। আশ্রয়ের খোঁজে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পাওয়ার পরও মহামারী ও নানা কারণে মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এসবই গণহত্যার মধ্যে অন্তর্গত।
বিভিন্ন উপায়ে সে সময় মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কখনও কখনও নির্দিষ্ট একটি জায়গায় মানুষ এনে হত্যা করা হতো; যেমন, রায়েরবাজার বা মিরপুরের জলাভূমিতে। এসব জায়গা আমাদের কাছে পরিচিত বধ্যভূমি হিসেবে। অনেক সময় কিছু মানুষকে হত্যা করে একই সঙ্গে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। এসব কবর আমাদের কাছে গণকবর হিসেবে পরিচিত।
নির্যাতনের পরিধি ব্যাপক। প্রতিদিন হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। তাদের হত্যা করেছে। অল্পসংখ্যক মানুষ নির্যাতন কেন্দ্র থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন। সব বয়সের নারীরা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নিয়ত ধর্ষণ করা হয়েছে। এ কারণেও মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আমরা এসব মৃত্যুকেও গণহত্যার অন্তর্গত করব। মানুষ পালিয়ে গেছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহায়-সম্পত্তি ফেলে। রাস্তাঘাটে মানুষকে হিন্দু না মুসলমান তা পরীক্ষা করা হয়েছে। সর্বত্র একটি আতঙ্কের সৃষ্টি করা হয়েছে। নির্যাতন করার জন্য শুধু ক্যাম্প নয়, আলাদা জায়গাও নির্দিষ্ট করা হতো। এসব কিছুই নির্যাতনের অন্তর্গত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ৫ লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সরকার তাদের সম্মান করে ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু পরে এই অভিধা সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কত মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, তার হিসাব জানা যাবে না। তবে এক কোটি নারী-পুরুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। শরণার্থী শিবিরে মানবেতর পর্যায়ে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। এটিও নির্যাতনের অন্তর্গত।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী। তারা বিভিন্ন কিলিং স্কোয়াড গড়ে তুলেছিল। যেমন আলবদর বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘকে সম্পূর্ণভাবে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তর করা হয়। আলী আহসান মুজাহিদ ছিলেন এর উপনেতা। কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা প্রমুখ ছিলেন আলবদর বাহিনীর সংগঠক ও নেতা। ছাত্রসংঘের বাইরেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মী ও অবাঙালিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল আরেকটি হত্যাকারী বাহিনী আলশামস।
মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন, জামায়াতের গোলাম আযম, নেজামে ইসলামের ফরিদ আহমদ প্রমুখের উদ্যোগে বাংলাদেশজুড়ে সংগঠিত হয়েছিল শান্তি কমিটি। বলা হয়েছিল, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও বজায় রাখার জন্য এ কমিটি করা হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যন্ত এ কমিটি গঠিত হয়েছিল। তবে এর মূল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের খোঁজখবর সেনাবাহিনী বা রাজাকারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, পরিত্যক্ত বাড়িঘর লুট করা, সম্পত্তি দখল করা প্রভৃতি। শান্তি কমিটির সদস্যরা এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণহত্যা ও প্রত্যক্ষভাবে নির্যাতনের জন্য দায়ী।
স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, অবাঙালি, রাজনৈতিক কর্মী না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল রাজাকার বাহিনী। প্রথমে জামায়াতের একেএম ইউসুফ খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পরে পাকিস্তান সরকারের অধীনে এই বাহিনী সংগঠিত করা হয়। এরাও হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
রাজনৈতিক দল হিসেবে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী, নূরুল আমীনের নেতৃত্বে পিডিপি, ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, খান-এ-সবুর খান প্রমুখের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষভাবে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনে প্রণোদনা জুগিয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেটি নিয়ে ইদানীং আগ্রহ-বিতর্ক দু-ই দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমি একেবারে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করিনি। কেননা এই বিতর্ক এবং তারপর আগ্রহ গণহত্যার বিষয়টিকে আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। সম্প্রতি ইয়েমেন, সুদান প্রভৃতি দেশে বিশেষ করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও অং সান সু চির সরকার যৌথ সম্মতিতে রাখাইন রাজ্যে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে এটিই প্রমাণিত যে, গণহত্যা বিষয় হিসেবে এখনও প্রাসঙ্গিক।
একটি গণহত্যায় কতজন নিহত হয়েছেন, তার নির্ভুল সঠিক হিসাব আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। গণহত্যার তীব্রতা, স্থায়িত্ব, জনসংখ্যা সব মিলিয়ে গণহত্যায় নিহতদের আনুমানিক হিসাব করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ইউরোপজুড়ে নাৎসি, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যালানজিস্টরা যে গণহত্যা চালায়, তার সময়সীমা ছিল চার বছরের ওপর। এলাকার ব্যাপকতা ছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ খুবই ছোট, জনঘনত্ব খুব বেশি। সে কারণে এখানে গণহত্যায় একটি সুবিধা পায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্যরা, রাজাকাররা। অর্থাৎ এখানে গণহত্যা ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। দ্রুত হয়েছে এবং জনঘনত্ব থাকায় বেশি মানুষ হত্যা সম্ভব হয়েছে। যেমন, চুকনগরে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশিষ্ট্য হলো, এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কোথাও আর হত্যা করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক