এ কে এম শহীদুল হকঃ
আমি একবার আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ব্যাংকক থেকে কুয়ালালামপুরে রওনা দিলাম। থাইল্যান্ডের রাজধানী শহর এবং মালয়েশিয়ার রাজধানী শহরের মধ্যে দূরত্ব ১৪৭৩ কিলোমিটার। সড়কপথে ভ্রমণ করলে অনেক শহর ও গ্রামের দৃশ্য দেখা যাবে, আবার ভ্রমণ খরচও কম হবে। তাই বাসযোগে রওনা হলাম। বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের ৫-৭ মিনিট আগে সাদা সাফারি পরিহিত মধ্যম বয়সের এক লোক বাসের চালকের সিটে এসে বসলেন। তিনি তার নিজ ধর্ম মোতাবেক সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে স্তুতিবাক্য পাঠ করলেন। সেজদার আদলে গাড়ির স্টিয়ারিং কপালে স্পর্শ করলেন। যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাস চালানো শুরু করলেন। ১৯৯৩ সালের কথা বলছি। তখন আমি কম্বোডিয়াতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত। ছুটি কাটাতে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ভ্রমণ করি। চালক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে থামলেন। কন্ডাক্টর যাত্রীদের গাড়ি থেকে নেমে কিছু খেয়ে নিতে অনুরোধ করেন। প্রায় আধ ঘণ্টা বিরতির পর বাস চলা শুরু করল। এবার নতুন চালক। নতুন চালকও একইভাবে প্রার্থনা করে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। প্রথম চালক তার পুরো সময় অত্যন্ত সতর্কভাবে পারদর্শিতার সঙ্গে সাধারণ গতিতে গাড়ি চালিয়েছেন। যাত্রীরা বেশ নিরাপদবোধ করছিলাম। দ্বিতীয় চালকও একইভাবে গাড়ি চালিয়ে তার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছেন।
আমি লক্ষ্য করলাম, চালকদ্বয় অত্যন্ত দক্ষ, পেশাদার, দায়িত্বশীল ও মার্জিত। তারা সৃষ্টিকর্তার কৃপা প্রার্থনা করে যাত্রা শুরু করলেন এবং সারা রাস্তা যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালালেন। অথচ ২০১৯ সালে এসেও আমাদের দেশের চালকদের মধ্যে সেই রকম পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যের প্রতি অনুরক্তি ও সচেতনতাবোধ সৃষ্টি হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার বহুবিধ কারণ থাকলেও চালকদের অবহেলা, অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং নিরাপত্তাজ্ঞানের অভাবের কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
গত ১৯ মার্চ রাজধানীর প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস সকাল ৭টায় জেব্রা ক্রসিংয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র আবরারকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। গত বছর ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে একটি বাস দু’জন শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যা করার পর শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছিল। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। আবরার আহমেদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। জেব্রা ক্রসিং পথচারীদের জন্য। এখানে পথচারীরা অগ্রাধিকার পাবে। পথচারীদের দেখলে গাড়ি থেমে যাবে। পথচারীদের পারাপারের পর গাড়ি চলবে। আমাদের দেশের চালকরা তা জানে না অথবা জেনেও মানে না। ট্রাফিক আইনের এটা গুরুতর লঙ্ঘন।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধু তাদের নিরাপত্তার জন্যই নয়। এ আন্দোলন গোটা দেশবাসীর নিরাপত্তার জন্য। মানবতার জন্য। ঘর থেকে বের হয়ে কারও সন্তানই যেন লাশ হয়ে ফিরে না আসে, তার জন্য এ আন্দোলন। কিন্তু এ আন্দোলন করেই কি সড়ক নিরাপদ করা যাবে? তা হয়তো হবে না। কিন্তু সরকার ও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেককে তো নাড়া দেবে। সে নাড়া থেকে কিছু একটা করার তাগিদ তাদের মধ্যে জাগবে। আর সে তাগিদ থেকেই সমস্যা সমাধানের একটা পন্থা বের হবে- এ প্রত্যাশাই সবার।
সড়ক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী ফ্যাক্টরগুলো হলো- অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত ও বেপরোয়া চালক; চালকদের অজ্ঞতা, দায়িত্বহীনতা, অসংবেদিতা, অসচেতনতা; অধিক গতিতে গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জ্ঞানের অভাব। এ ছাড়া চলাচলের অযোগ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও অননুমোদিত যানবাহন, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; একই রাস্তায় দ্রুত ও ধীরগতির গাড়ি চলাচল, যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো; আইন প্রয়োগের শিথিলতা, অস্বচ্ছতা ও প্রতিবন্ধকতা; আইন না মানার সংস্কৃতি, নাগরিকদের সচেতনতার অভাব, নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতা, ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করে যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া ইত্যাদি।
দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পেশাদার, সচেতন, দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল পরিবহন শ্রমিক তৈরি করা সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনা অন্তত ৭০ শতাংশ হ্রাস পাবে। যে চালকের কাছে একটি গাড়ি এবং সে গাড়িতে যাত্রী পরিবহনের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হবে, তাকে অবশ্যই মানসিক ও শারীরিকভাবে যোগ্য হতে হবে। দক্ষ, পেশাদার ও দায়িত্বসচেতন চালক অপরিহার্য। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই চালক তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে চালকদের সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলাও জরুরি। দক্ষ ও পেশাদার চালক তৈরির দায়িত্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুকারী সংস্থাকেই নেওয়া বাঞ্ছনীয়। যোগ্য চালক নিয়োগ, তাদের ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চালক ও হেলপারদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা-বোনাস ও প্রণোদনা প্রদান এবং তাদের কল্যাণ দেখার দায়িত্ব মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এবং সড়ক পরিবহন কোম্পানিগুলোকেই নিতে হবে।
গাড়ির ফিটনেস দেওয়ার ব্যাপারে বিআরটিএকে শতভাগ স্বচ্ছ হতে হবে। চলাচলের অযোগ্য কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি যেন কোনোক্রমেই ফিটনেস সার্টিফিকেট না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আয়ুস্কাল উত্তীর্ণ যানবাহন অবশ্যই সড়ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলতে হবে। সড়ক ও মহাসড়কে যেসব ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হয়; সংশ্নিষ্ট সড়ক প্রকৌশলীদের সেসব ত্রুটি দূর করে সড়ককে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে হবে। মহাসড়কগুলোতে রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন যেমন নছিমন-করিমন-ভটভটি ইত্যাদি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে অথবা তাদের জন্য আলাদা লেন করে দিতে হবে।
চালক ও নাগরিকদের মধ্যে আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। চালকরা মোটরযান সংক্রান্ত আইন-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলবে এবং পথচারী তথা নাগরিকদের ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। সবাইকেই নিজের ও অন্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। পেশাদার, নিরাপত্তা সচেতন, দায়িত্ববান, নিজের ও অন্যের নিরাপত্তার প্রতি সংবেদনশীল এবং বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন চালকই পারেন দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে। একইভাবে নিরাপত্তা সচেতন নাগরিকরা পারেন নিজেকে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে। এ লক্ষ্যে সচেতনমূলক প্রচার সর্বদাই বিভিন্ন উপায় ও কৌশলে অব্যাহত রাখতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণদের ট্রাফিক আইন ও নিরাপত্তা সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান দিতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যমের প্রচারণা অপরিহার্য।
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি :স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচির মধ্যে বৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের জন্য কমপক্ষে সাত দিনের সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণমূলক এবং আইন-কানুন ও বিধিবিধানের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। যেসব চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই অথবা কোনো লাইসেন্স নেই অথচ নিয়মিত গাড়ি চালায়, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রয়োজনে লাইসেন্স প্রদানের শর্ত কিছুটা শিথিল করে পরীক্ষা নেওয়া যায়। উত্তীর্ণদের লাইসেন্স ইস্যু করে কমপক্ষে সাত দিনের সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বৈধ লাইসেন্স ব্যতীত কেউ গাড়ি চালালে তার বিরুদ্ধে আইনের কঠোর বিধান থাকা প্রয়োজন।
আয়ুস্কাল উত্তীর্ণ এবং চলাচলের অযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন জব্দ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রবর্তন করে বাসের জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। চালকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। চালকদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। একনাগাড়ে ৫-৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কোনো চালককে গাড়ি চালাতে দেওয়া উচিত না। প্রত্যেক গাড়িতে দু’জন চালক রাখতে হবে। মাদকাসক্তদের অবশ্যই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার অনুপযোগী ঘোষণা করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতে রুটভিত্তিক পরিবহন চলাচল পদ্ধতি বাতিল করে একাধিক সীমিত সংখ্যক কোম্পানি গঠন করা প্রয়োজন। কোম্পানির অধীনে যানবাহন পরিচালিত হবে। গাড়ির মালিকরা কোম্পানির কাছ থেকেই মুনাফা নেবে। চালক ও শ্রমিকরা কোম্পানির অধীনে চাকরি করবে। চালক, শ্রমিক ও কর্মচারীর চাকরি এবং তাদের আচরণ কোম্পানি কর্তৃক প্রণীত চাকরি বিধিমালা মোতাবেক নিয়ন্ত্রিত হবে। কোম্পানি তাদের বেতন-ভাতা-বোনাস, ইউনিফর্ম, পেনশন ইত্যাদি প্রদান করবে। ব্যক্তিগতভাবে মালিকের সঙ্গে চালকদের কোনো পেশাগত সম্পর্ক থাকবে না। এতে চালকদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের জবাবদিহিও থাকবে।
দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি :দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রচলিত বিধানের সংস্কার এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নির্মাণ এবং প্রশিক্ষক ও জনবলের মঞ্জুরি দিতে হবে। মহানগর ও বড় বড় শহরে উন্নত দেশের মতো আধুনিক ডিজিটালাইজড ট্রাফিক ও নিরাপত্তা নজরদারির ব্যবস্থা চালু করলে ট্রাফিক শৃঙ্খলা উন্নত হবে এবং দুর্ঘটনাও কমে যাবে। সব যানবাহন ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের আওতায় এলে চালকরা ভয়ে আইন ভঙ্গ করে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে সাহস পাবে না।
সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ যেমন ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, সাবওয়ে, ওভারপাস, আন্ডারপাস, চার-ছয় লেনে সড়কের প্রশস্তকরণ, রেলপথ ও নৌপথের উন্নয়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে এসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সড়ক ও মহাসড়কে বাস-বে, সার্ভিস রোড, পর্যবেক্ষণ ও স্পিড ক্যামেরা স্থাপন অপরিহার্য। প্রয়োজনে উড়াল সেতু, ওভারপাস, ইউ লুপ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত অব্যাহত প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে হবে। তবে যত ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, সংশ্নিষ্ট সবাই সচেতন না হলে, দায়িত্বশীল আচরণ না করলে এবং আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি না হলে অবস্থার উন্নয়ন কঠিন হবে।
সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ