ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত জোট থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতার মুখে পড়তে হবে না ক্ষমতাসীনদের। তবে রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে এখন পৃথক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর অন্তত দুটি শক্তিধর দেশ জার্মান ও ফ্রান্সের সঙ্গে। এর বাইরে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও পৃথক নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ব্রিটেনের জোটে থাকার পক্ষে ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইউ) দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার জনরায় এখন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক পৃথক সম্পর্কের দিকে জোর দিতে হবে। ইউভুক্ত দেশগুলোর ভেতর থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা এসব কথা বলেন। ইউরোপীয় ২৮টি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
তারা জানান, ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকার কারণে শুধু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেই ইউভুক্ত অন্য দেশগুলোকে নিয়ে তেমন ভাবতে হতো না বাংলাদেশকে। কারণ ইইউভুক্ত ২৮ দেশের প্রায় সবটাকে ‘ডোমিনেট’ করতো যুক্তরাজ্য। তাই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেই ইইউ নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়তো না বাংলাদেশের। ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, যুক্তরাজ্যের জনগণের সরাসরি ভোটে যুক্তরাজ্য আলাদা হওয়ার পর এখন ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মান ও ফ্রান্স সবচেয়ে শক্তিধর হয়ে পড়েছে। তাই জার্মান ও ফ্রান্সের সঙ্গে পৃথক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নিতে বেশি করে কূটনীতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে, সেইসঙ্গে রাজনীতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। ওইসব নেতারা বলেন, জার্মানের সঙ্গে আমাদের রফতানি সম্পর্ক রয়েছে, তাই সে দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্কও জরুরি।
তাছাড়া ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কোনও জটিলতা সৃষ্টি করবে না বাংলাদেশে। তবে বাণিজ্যিক কিছু সমস্যায় পড়তে হতে পারে সরকারকে। এ সমস্যার কারণেই যুক্তরাজ্য ইইউভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে থাকুক তা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এজন্য সরকারের জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায়। তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচরণাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্রিটেনের ৫২ শতাংশ জনগণ ইইউভুক্ত না থাকার জন্যে ভোট প্রদান করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত জোট থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা প্রতিক্রিয়া পড়বে। বাংলাদেশে সরাসরি এর কোনও প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। রাজনৈতিক কোনও সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ট্রেডিশনাল যে সম্পর্ক তাই অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ব্রিটেনে ইউভুক্ত জোটে থাকার কারণে ইউভুক্ত অন্যান্য দেশ নিয়ে তেমন ভাবতে হতো না। এখন ইইউভুক্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
জানতে চাইলে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া জনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনও প্রভাব পড়বে না। তবে রাজনৈতিক পৃথক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বরোপ করতে হবে। তিনি বলেন, আগে ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোকে নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা করার দরকার হতো না। এখন ইইউ’র প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার মতো ’দুর্ভাগ্যজনক’ সিদ্ধান্ত যদি যুক্তরাজ্য নিয়ে নেয় তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধীনে যুক্তরাজ্য যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সব অকার্যকর হয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সদস্য হবার কারণে যুক্তরাজ্য এটি পালন করছে কিন্তু যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত তার জন্য বলবত থাকবে না। ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে যুক্তরাজ্যকে ঘোষণা দিতে হবে দেশটি আগের দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এবং এরপর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বাণিজ্য সুবিধার বিষয়টি মীমাংসা করতে হবে। বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সাহায্য, সহযোগিতা, অর্থনৈতিক লেনদেন, পরিবহন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী লন্ডনে সরাসরি পণ্য পাঠায় এবং সেখান থেকে ইউরোপের অন্য দেশ যেমন- জার্মান, ফ্রান্স বা অন্য কোথাও পাঠায়।
উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে।
ব্রিটেনে এই জোটে থাকুক তা চেয়েছিল ক্ষমতসীন আওয়ামী লীগ। গত মে মাসে জাপানে জি-সেভেন এর আউটরিচ প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন এর মধ্যে একটি বৈঠক হয়। জানা গেছে, বৈঠকে শেখ হাসিনা ক্যামেরুনকে বলেন- অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যহত রাখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকাটাই যুক্তরাজ্যের জন্য লাভজনক হবে। যদি যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় তবে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার পাওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আবার নতুন করে আলোচনা করতে হবে। বিষয়টিকে এতই সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্যে তিনি জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ব্রিটেনে পাঠান।
[বাংলা ট্রিবিউন]