সেলিনা হোসেনঃ
ফেনীর সোনাগাজীতে ৬ এপ্রিল সকালে মাদ্রাসায় গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এক ছাত্রীকে হত্যাচেষ্টার পৈশাচিক উল্লাসের ঘটনাটি প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে- সবুজ-শ্যামল আমাদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশের সমাজকে এ কোন অবক্ষয় গ্রাস করেছে? নুসরাত জাহান রাফি নামের শিক্ষার্থী ৬ এপ্রিল সকালে পরীক্ষা শুরুর আগে এই বর্বরোচিত ঘটনার শিকার হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত খবরে জানা যায়, ওই মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য রাফিকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। সে তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে বোরকা পরিহিত ক’জন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা অনেকেই মনে করি, মাদ্রাসা মূলত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত ও শিক্ষা লাভের জন্য যান, তারা হয়তো ধর্মীয় মূল্যবোধে অধিকতর পুষ্ট। কিন্তু এখন হয়তো অনেকেরই এই ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য।
গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি- রাফিকে বলা হয়, ওই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ভবনের ছাদে তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে। স্বভাবতই এমন খবরে সে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। বিবেক ও বন্ধুত্বের টানে তাই হয়তো রাফি ছুটে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরই তাকে ঘিরে ধরে বোরকা-মুখোশ পরা ক’জন। তারা তাকে শাসাতে থাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্নীলতাহানির অভিযোগ আনার জন্য। জবাবে রাফি নাকি জানিয়েছিল, তার আনীত অভিযোগ সত্য এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সে তার প্রতিবাদ করবে। এরপরই তার ওপর হামলে পড়ে মানুষ নামধারী হায়েনারা। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ কারাবন্দি। কিন্তু তার পালিত দানবরা তো মুক্ত। যারা রাফির ওপর হামলে পড়ে পৈশাচিকতা-বর্বরতার ছোবল বসিয়েছে অর্থাৎ ওই চার বোরকা পরাকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি (সমকাল, ৮ এপ্রিল)। কিন্তু একই দিন সমকালে প্রকাশিত ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার অপকর্মের দীর্ঘ খতিয়ান প্রকাশিত হয়েছে। শুধু রাফিই নয়, চলতি বছর একই মাদ্রাসার আরেক ছাত্রী তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনে।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগেরই প্রতিকার হয়নি। এ রকম অনেক ঘটনা বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে চাপা পড়ে গেলেও আইনের আওতায় এসেছে এমন ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। এ রকম অভিযোগের জের ধরে এমন বর্বরোচিত ঘটনার নজির আছে বলে আমার জানা নেই। অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা একটি সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের যে মূল হোতা এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে তার বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের যেসব অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলোর যথাযথ প্রতিকার হলে হয়তো আজ রাফি এমন নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার শিকার হতো না। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে রাফি। তাকে বাঁচানো যাবে কি-না এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। রাফিকে পুড়িয়ে মারার যে উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটল, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও যেন হার মানায়। যারা রাফিকে তার অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছিল, তারাও অপরাধী। এমন বলবানরা সমাজের নানা স্তরে মুখোশ পরে বিচরণ করছে বিধায়ই বর্বরতার খতিয়ান দীর্ঘ হচ্ছে।
পরীক্ষা কেন্দ্রে কেরোসিন কিংবা দাহ্য পদার্থ নিয়ে রাখা, রাফিকে মিথ্যা বলে ছাদে নেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে এমন নৃশংসতার অধ্যায় রচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পনার ভিত্তিতেই। এও অভিযোগ আছে যে, শ্নীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মুক্তি চেয়ে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বিক্ষোভও করেছেন। এতে এও প্রমাণিত হয়, একজন নৈতিক অবক্ষয়কারীর পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যাও কম নয়। ওই অধ্যক্ষের পক্ষ নেওয়া চক্রটি যে যথেষ্ট বলবান, ঘটনাটি এরও যেন সত্যতাই তুলে ধরে। সমাজকে কলুষতার ছায়ায় যারা ঢেকে দিচ্ছে কিংবা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে, তারা অস্পর্শিত থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী ওই ছাত্রীর সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছেন এবং এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ স্বস্তি জুগিয়েছে; কিন্তু দুর্বৃত্তদের যাতে দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ড হয় এই প্রক্রিয়াটা চালাতে হবে প্রশাসনের সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, শ্নীলতাহানি ও নানারকম অপকৌশলে নিপীড়নের শিকার হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। ফেনীর সোনাগাজীর ঘটনাটিকে কেবল মর্মান্তিক বললে বোধকরি কম বলা হয়। কিছু কিছু নিকৃষ্ট ঘটনা আছে, সেগুলো সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কিন্তু রাফির ঘটনায় কম বলার অবকাশ নেই। অনেকের মতো আমিও এই ঘটনায় শুধু মর্মাহতই নই, চরম ক্ষুব্ধও। যারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, বিশেষ করে মাদ্রাসায় পড়ূয়া মেয়েরা হয় অধিকতর ধর্মভীরু। তারা অনেক সময়ই অনেক কিছু সহ্য করে যায়। কিন্তু রাফির হয়তো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলেই সে আইনি প্রতিকার চেয়েছিল। নিকট অতীতে কয়েক মাসের ব্যবধানে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধর্ষণের দুটি ঘটনা ঘটেছে, যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তাতে বলা যায়, মেয়েদের জীবনযাত্রায় ঝুঁকি এখনও অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হওয়ার কথা। কিন্তু একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধেই যখন যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে, তখন সহজেই অনুমান করা যায় পরিস্থিতি কতটা বৈরী।
ফেনীতে সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, এমন বর্বরতা আমাদের গণমানুষের ভেতরে কী করে থাকছে,স্বাধীন বাংলাদেশে স্বপ্ন সৌধের জায়গা থেকে এটা চিন্তা করা কঠিন। এই জঘন্যতম বর্বরতা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। আমরা উন্নয়নের পথে এগোচ্ছি। বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে এবং আরও অর্জনের পথ রচনা করছে। বিশ্বে এখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই রোল মডেল। তারপরও এই সীমাহীন বর্বরতা আমাদের শুধু মর্মাহতই করে না, মানবিক চেতনাবোধকেও বিপর্যস্ত করে। ভাবতে কষ্ট হয়, আমরা কি সেই সমাজের মানুষ, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য জীবনদানকারী জনসমাজের অধিবাসী? ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যে বিকাশ এ সময়ে আমরা দেখতে পাই, তাতে এই ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা পৌঁছে যাবে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষের কাছে।
আমরা এই সমস্যা কীভাবে অতিক্রম করব, সেটাও আমাদের সামনে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মূল্যবোধের এই অবক্ষয় শুধু আইন-আদালত দিয়ে ঠেকানো যাবে না। ব্যক্তির নৈতিক বোধ-বিবেক সঞ্চাত চেতনা যদি বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে, তাহলে এমন মর্মান্তিক বর্বরতার উল্লাসচিত্র আমাদের সামনে বারবারই ফিরে আসবে। আমরা এই বর্বরতার অবসান চাই। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি যেন আমাদের আর গ্রাস করে না ফেলে, এখন সেদিকটায় অধিকতর মনোযোগ দেওয়াই সময়ের মুখ্য দাবি। আমরা সরকার থেকে, বিচার ব্যবস্থা থেকে, ব্যক্তির মূল্যবোধের জায়গা থেকে যথাযথ সহযোগিতা পেয়ে নিজেদের পরিশীলিত করার অগ্রযাত্রায় বিরামহীন চলতে চাই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীলরা যেন তাদের সবটুকু সাধ্য দিয়ে এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়ে সচেতনভাবে রাশ টেনে ধরেন মানুষের সুস্থ জীবন পরিচর্যার পক্ষে। সরকারের কাছ আবেদন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে দেখাতে হবে অপরাধীদের ছাড় পাওয়ার পথ রুদ্ধ।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি নির্যাতনের যে চিত্রগুলো আমরা হাজার বছর ধরে দেখেছি একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে তার পুনরাবৃত্তি হবে, এটা ভাবা কঠিন। সমাজের অগ্রগতি মানবিকতার জন্য, সুস্থতার জন্য একটি বড় নির্মাণ। এই নির্মাণের পক্ষে সবার অবস্থান আজকের বাংলাদেশে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। পত্রিকার পৃষ্ঠায় রাফির ব্যান্ডেজ করা দেহের ছবি দেখে কিছুতেই নিজের দেশের মানুষের দিকে ফিরে তাকাতে প্রেরণা পাচ্ছি না। কারণ গণমাধ্যমের খবর থেকে জেনেছি, যারা এই বর্বরতার হোতা তাদের মধ্যে মেয়েও নাকি ছিল! এমন অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় হবে তদন্তে; কিন্তু এই প্রশ্নবিদ্ধ জায়গাটি থেকে আমাদের উচ্চারণ- মনুষ্যত্ব বোধে উজ্জীবিত হোক আমাদের প্রজন্ম। দৃষ্টান্তযোগ্য বিচার হোক এই বর্বরতার।
কথাসাহিত্যিক ও চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।